যুগান্তর : চীনের উহান শহরে থ্রি গোর্জেস ইউনিভার্সিটির ১৭১ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন। এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবাসিক হলে থাকেন সেটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। এতে কেউ বাইরে বের হতে পারছেন না। তাদের খাবার ও পানি ফুরিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কোনো খাবার সরবরাহ করছে না।
এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবন বাঁচাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সরকারের কাছে সাহায্যের আকুতি জানিয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। দ্বীন মুহাম্মদ প্রিয় নামের এক শিক্ষার্থী এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘আমাদের ট্রেন, স্টেশন ও বিমানবন্দর বন্ধ। সরকারের সাহায্য ছাড়া আমরা এখান থেকে বের হতে পারব না।’
তবে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত কোনো রোগী নেই। চীন থেকে আর কাউকে ফেরত আনা হবে না বলেও জানান তিনি। কেউ আসতে চাইলে তাকেও নিরুৎসাহিত করা হবে।
ঢাকায় কর্মরত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সাংবাদিকদের বলেন, চীনে কোনো বাংলাদেশি এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। তাই করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে পেঁয়াজ আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না।
এদিকে চীনে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে বাংলাদেশে মাস্কের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তবে সবার মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর।
সংস্থাটি বলছে, শুধু চীনফেরতদের কেউ অসুস্থ হলে তিনি ও তার সেবাদাতারা তা ব্যবহার করবেন। এদিকে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ অর্থে স্বাস্থ্য খাতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করা হবে।
চীনে এ ভাইরাসে বুধবার আরও ৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬৩ জন। অন্যদিকে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৮ হাজার। এছাড়া আক্রান্ত ৮৯২ জন সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল ছেড়েছেন বলে দাবি করেছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
চীন থেকে আর কাউকে ফেরত আনা হবে না -স্বাস্থ্যমন্ত্রী : বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে করোনাভাইরাস বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, চীন থেকে আর কাউকে ফেরত আনা হবে না। কেউ আসতে চাইলে তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। যারা ছুটিতে চীনে গেছেন এ মুহূর্তে তাদের আপাতত ভিসা দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। চীনাদের অন-এরাইভাল ভিসা আপতত বন্ধ। চায়না থেকে যারা ভিসা নিয়ে আসবে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট দিতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের সব মানুষকেই মাস্ক পরে বাইরে ঘোরার প্রয়োজন নেই। যাদের সর্দি, কাশি, জ্বর আছে শুধু তারাই মাস্ক ব্যবহার করবে, যাতে তাদের কাছ থেকে কোনো ছোঁয়াচে রোগ অন্যদের সংক্রমিত করতে না পারে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, নৌবন্দরগুলোতে স্ক্যানিং মেশিন বসানো হয়েছে। জনবল বাড়ানো হয়েছে যেন ২৪ ঘণ্টা সেবা দেয়া যায়। করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য আমাদের এখানে আগে থেকেই ব্যবস্থা ছিল। সেটাকে আরও আধুনিক করা হয়েছে। করোনাভাইরাস কিটস আনা হয়েছে। ফলে অল্প সময়ে পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলন : বৃহস্পতিবার মহাখালীতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরে করোনাভাইরাস ঠেকাতে পদক্ষেপের সর্বশেষ তথ্য নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন সংস্থাটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি বলেন, অনেকের মধ্যে কনফিউশন আছে মাস্ক ব্যবহার করবে কী করবে না। আমাদের দেশে এখনও নভেল করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। যারা চীন থেকে এসেছে তাদেরও আমরা আইসোলেশনে রেখেছি। সুতরাং সবার মাস্ক ব্যবহার করা প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, চীন থেকে আসা সন্দেহজনক ব্যক্তি যার জ্বর, কাশি, গলাব্যথার মতো উপসর্গ রয়েছে সে মাস্ক ব্যবহার করবে। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সেবাদাতা মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। যারা হোম আইসোলেশনে আছেন বা উহান থেকে যারা এসেছেন, তাদের সংস্পর্শে যারা যাবেন তারা মাস্ক ব্যবহার করবেন।
এছাড়া চিকিৎসক যারা আছেন তাদের মাস্ক ব্যবহার করা প্রয়োজন। চীনের উহান থেকে ফিরিয়ে এনে আশকোনায় হজক্যাম্পে রাখা কারও মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নেই বলে আইইডিসিআরের পরিচালক জানিয়েছেন।
ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন এমন সন্দেহে বুধবার পর্যন্ত ৫০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে কারও শরীরেই করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। এটা স্বস্তির যে, আমরা এখন পর্যন্ত কোনো নমুনার মধ্যেই করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাইনি। তিনি জানান, উহান ফেরতদের মধ্যে যে তিনজনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে দু’জনকে আশকোনা হজক্যাম্পে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। একজনের ‘কাফ ইনজুরি’ থাকায় তাকে সেখানে রাখা হয়েছে। আর জ্বর নিয়ে সিএমএইচে যাওয়া শিশুটির নমুনা পরীক্ষার ফল এখনও পাওয়া যায়নি।
আশকোনার হজক্যাম্পে অবস্থানকারীদের পরিবারের সদস্যরা চাইলে আইইডিসিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। এজন্য প্রতিদিন বেলা ৩টায় তারা আসতে পারেন বলে মীরজাদী সেব্রিনা জানিয়েছেন।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীন থেকে আসা সাত হাজার ৬৯৩ জনের স্ক্রিনিং হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় স্ক্রিনিং হয়েছে ১৩৬ জনের। এদের কারও শরীরেই করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা যায়নি।
চীনে কোনো বাংলাদেশি করোনা আক্রান্ত নয় -চীনা রাষ্ট্রদূত : ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো চীনা নাগরিক এবং চীনে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি। ঢাকায় চীনা দূতাবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে এ নিয়ে সচেতন থাকুন। অতীতে ইবোলা ভাইরাস, সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসে যেসব লোক আক্রান্ত হয়েছে, সেই তুলনায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। এ ভাইরাস প্রতিরোধে চীন সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে।
৬৭ কোটি ডলার চায় ডব্লিউএইচও : বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে ৬৭ কোটি ৫০ লাখ (৬৭৫ মিলিয়ন) ডলার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও। প্রাণঘাতী এ ভাইরাস যাতে আর ছড়াতে না পারে এবং দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে- এমন দেশগুলোকে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত করতে ফেব্র“য়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে এই অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছে সংস্থাটি।
চীনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৬৩ : সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বুধবার আরও ৭৩ জনসহ শুধু চীনে এ ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৫৬৩ জনে পৌঁছেছে; আর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৮ হাজার ২৫৬ জনে। অন্যদিকে সুস্থ হওয়ার পর ৮৯২ জন বিভিন্ন হাসপাতাল ছেড়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। এদিকে চীনের বাইরে এ ভাইরাসে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে ফিলিপাইন ও হংকংয়ে। ফিলিপাইনে মৃত ওই ব্যক্তির বয়স ৪৪ এবং হংকংয়ের বাসিন্দার বয়স ৩৯। সম্প্রতি তারা উভয়েই উহান থেকে ফেরেন।
রূপগঞ্জে করোনাভাইরাস আতঙ্ক : রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রয়েছে দেশি-বিদেশি শতাধিক বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধেকেই চীন দেশের নানা প্রযুক্তি থাকায় সরাসরি সে দেশের প্রকৌশলী, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন অবস্থান করছেন রূপগঞ্জে। তাদের জন্য আলাদা হাটবাজার না থাকায় দৈনন্দিন কাজে তারা বের হচ্ছেন রূপগঞ্জের আনাচে-কানাচে। এতে স্থানীয়দের মাঝে করোনাভাইরাস আতঙ্ক কাজ করছে। এ কারণে চীনাদের অবাধ বিচরণ থামাতে সরকারি উদ্যোগের দাবি জানান তারা।
আপনার মতামত লিখুন :