রাশিদ রিয়াজ : ভারতের লোকসভায় সোমবার নিজের আসনে দাঁড়িয়ে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়কে উদ্দেশ করে বিজেপি সাংসদ প্রবেশ বর্মা বললেন সবাই মিলে বলুন জয় শ্রীরাম তাহলেই সব পাপ মুছে যাবে। ছেড়ে কথা বললেন না তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রও। বিজেপি যে ভাবে বিরোধীদের আক্রমণ করেছে, তার জবাব দিয়েছেন মহুয়া। তাঁর কথায়, ‘এই সরকার নম্রতা হারিয়েছে৷ মনে রাখতে হবে ৯০ কোটি ভোটারের মধ্যে আপনারা মাত্র ২৩ কোটি মানুষের ভোট পেয়েছেন৷ এই পরিস্থিতিতে দেশের ১৩০ কোটি জনগণের প্রত্যেকের উপরে ঔদ্ধত্য ফলানোর চেষ্টা করবেন না৷ গণতন্ত্রের আঙিনার বাইরে গিয়ে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না৷ আপনাদের কাছে আমাদের দিদিমা-ঠাকুমারা জঙ্গি, সন্তানরা ভারতবিদ্বেষী৷ আপনারা দেশের ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন৷’ রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপরে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে ফুঁসে ওঠেন মহুয়া৷
প্রবেশ বর্অ হলেন ভারতের সেই সাংসদ, যিনি দিল্লি নির্বাচনের প্রচার করতে গিয়ে কেজরিওয়ালকে সন্ত্রাসবাদী বলেছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন যে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাঁর কেন্দ্রে বেআইনি জমিতে যত মসজিদ আছে, সবকটাকে গুঁড়িয়ে দেবেন। শাহিনবাগকেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঠান্ডা করে দেবেন৷ এই মন্তব্যের জেরে তাকে ৯৬ ঘণ্টার জন্য দিল্লিতে প্রচার করতে দিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন৷ সেই প্রবেশকে দিয়েই রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপরে বিতর্ক শুরু করে বিজেপি৷
কেজরিওয়ালের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার লক্ষ্যে বিজেপি কোনও রাখঢাক না-করে হিন্দু মুসলিম মেরুকরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে দিল্লিতে৷ প্রবেশের এ দিনের ভাষণও ছিল সেই চেষ্টার একটি অঙ্গ৷ তিনি কী ভাবে এই মন্তব্য করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সৌগত রায়৷ তার পরেও বিরোধীদের আরও চড়া সুরে আক্রমণ করেন প্রবেশ। তাঁর হুঙ্কার, ‘যাঁরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে গালি দিয়েছেন, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের সবাইকে এক প্লেনে বসিয়ে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেব৷’ সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র প্রতিবাদ করেন মহুয়া৷ তিনি বলেন, ‘উনি এই ধরনের অসম্মানজনক মন্তব্য করতে পারেন না৷ কয়েকদিন আগেই নির্বাচন কমিশন ওঁকে ৯৬ ঘণ্টার জন্য নিষিদ্ধ করেছেন। দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিতে নিষেধ করেছে৷ তার পরেও উনি সংসদে দাঁড়িয়ে এ কথা বলছেন।’ লোকসভার অধ্যক্ষ তাঁর আপত্তি খারিজ করে দেন৷
দিল্লিতে আম আদমি পার্টি, বাংলার তৃণমূল এবং জাতীয় প্রেক্ষিতে কংগ্রেস---- প্রবেশ বর্মার ৬২ মিনিটের ভাষণ জুড়ে তীব্র আক্রমণ ছিল এদের নিশানা করেই৷ এই তিনটি দলই সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে৷ লোকসভায় দাঁড়িয়ে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, মোদী সরকার কোনওভাবেই সিএএ প্রত্যাহার করবে না৷ তিনি বলেন, ‘মনে রাখবেন, এটা রাজীব ফিরোজ খানের সরকার নয়, এটা নরেন্দ্র মোদীর সরকার৷’ এই প্রথম কোনও বিজেপি নেতা সংসদে দাঁড়িয়ে খোলাখুলি জানালেন, মোদী সরকার সিএএ প্রত্যাহার করবে না৷ এর আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লির নির্বাচনী জনসভায় বেশ কয়েকবার এই একই কথা বলেছেন৷
এর পাশাপাশি বিজেপি যে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল, তা প্রমাণ করতে গিয়ে এ দিন নিজের ভাষণের মধ্যে সংবিধানের প্রতিলিপি তুলে ধরেন প্রবেশ৷ তাঁর কথায়, ‘এই দেখুন আমি দেশের সংবিধান নিয়ে এসেছি৷ এখানে রাম-সীতা-শ্রীকৃষ্ণ ও হনুমানের ছবি আছে৷ তার মানে কি সংবিধান সাম্প্রদায়িক?’
কী ভাবে মোদী সরকার দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে লোকসভায় দাঁড়িয়ে তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন মহুয়া। তাঁর বক্তব্য, ‘যে ৩১ শতাংশ মানুষ ২০১৪ সালে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল, আমি তাদের মধ্যে ছিলাম না৷ যে ৩৭ শতাংশ মানুষ ২০১৯-এ ভোট দিয়েছে আপনাদের, আমি সেই দলেও ছিলাম না৷ এটা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস নয়৷ যারা আপনাদের ভোট দিয়েছে, তাদের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন আপনারা৷ শুধু হিন্দু ভোটের জেরে আপনারা ক্ষমতায় আসেননি৷ ক্ষমতায় এসেছেন সাধারণ মানুষের ভোটে৷’
মহুয়ার কথায়, ‘আপনাদের যারা ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে, তাদের নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন৷ এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কী? মানুষের ক্ষোভ আকাশ থেকে পড়েনি, তাদের অস্তিত্বে আঘাত লেগেছে। তাই ক্ষোভের জন্ম হয়েছে৷ এনপিআর, এনআরসি এবং সিএএ হল একই মুদ্রার অংশ৷ আপনারা মুখে রাম, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের কথা বলেন৷ আসলে জানেন ধর্ম কাকে বলে? রামপ্রসাদ বিসমিলের কথাতেই বলি, দেখনা জোর কিতনা বাজুয়ে কাতিল মে হ্যায়, সর যো উঠা একবার ও ঝুকতা নেহি ললকার সে, হাত জো উঠা একবার ও কাটতে নেহি তলওয়ার সে৷’
আপনার মতামত লিখুন :