রাশিদ রিয়াজ : ৮ জানুয়ারি ভোরে ইরাকে অবস্থিত দু'টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ১৩টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। কিন্তু মার্কিন বাহিনী একটি ক্ষেপণাস্ত্রও ঠেকাতে পারেনি। কী ঘটেছিল সেদিন? সেই পরিস্থিতির কিছুটা বর্ণনা উঠে এসেছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি'র আজকের প্রতিবেদনে।
আকাশে শক্তিশালী চোখ থাকার পরও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে পারেনি মার্কিন সেনারা। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় কয়েক ঘণ্টা পুরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল ইরাকে অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে সেনারা আকাশে তাদের শক্তিশালী নজরদারির নিয়ন্ত্রণ হারায়। যেন কয়েক ঘণ্টার জন্য অন্ধ হয়ে যায় তারা।
ইরাকের আইন আল-আসাদ মার্কিন বিমান ঘাঁটিটি যখন ইরানের একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে পর্যুদস্ত, তখন মুহূর্তের মধ্যে চোখে ধাঁধা লাগে মার্কিন সেনাদের। আকাশে মার্কিন সেনাদের অতি শক্তিশালী ও ব্যয়বহুল নজরদারি ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে।
সেদিনের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের অসহায়ত্বের চিত্রই ফুটে উঠেছে মার্কিন সেনাদের বক্তব্যে। আইন আল আসাদ ঘাঁটিতে যৌথ বাহিনী আয়োজিত গণমাধ্যমের পরিদর্শন অনুষ্ঠানে এএফপির সঙ্গে কথা হয় সেদিন ঘটনাস্থলে থাকা মার্কিন সেনাদের।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সময় ৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টা ৩৫ মিনিটে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র বিমান ঘাঁটিতে আঘাত করে। ঘাঁটিতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী মোতায়েন ছিল। ঘাঁটিতে নজরদারি রাখার জন্য ওই সময় মার্কিন সেনাদের সাতটি ড্রোন মানবশূন্য যান আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিকেলস (ইউএভিএস) ইরাকের আকাশজুড়ে উড়ছিল। এতে যুক্ত ছিল এমকিউ-১ সি গ্রে ঈগলস নামের অত্যাধুনিক নজরদারি ড্রোন যেগুলো ২৭ ঘণ্টা পর্যন্ত উড়তে পারে এবং চারটি পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে।
এর একজন পাইলট ২৬ বছর বয়সী স্টাফ সার্জেন্ট কসটিন হেরউইগ বলেন, ‘সংঘাত হতে পারে ভেবে আমরা এয়ারক্রাফটগুলো (ড্রোন) চালু রেখেছিলাম।’ ৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদে ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যার পর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইরান যখন মার্কিন ঘাঁটিতে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, তখন হেরউইগ গ্রে ঈগল চালাচ্ছিলেন। হামলার আগাম সতর্কতার নির্দেশ পেয়ে ঘাঁটির দেড় হাজার সেনার বেশির ভাগই দুই ঘণ্টা ধরে বাংকারে অবস্থান করছিল। তবে ১৪ জন পাইলটকে ঘোর কালো ভার্চ্যুয়াল ককপিটে বসে যানগুলোকে রিমোট কন্ট্রোলে উড়াতে হচ্ছিল। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরায় চোখ রেখে চারপাশের পরিস্থিতি দেখছিলেন তারা।
হেরউইগ বলেন, প্রথম ক্ষেপণাস্ত্রটি তাদের শেল্টারে আঘাত হানে। তবে পাইলটদের আগের অবস্থানেই থাকতে হয়। এরপর একের পর এক আঘাত হতে থাকে। তিনি ভাগ্যকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। সেনারা জানায়, তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। পাইলটদের অপারেশন কক্ষ লাগোয়া ঘুমানোর কোয়ার্টারে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত লাগে।ফার্স্ট সার্জেন্ট ওয়েসলে কিলপ্যাট্রিক বলেন, শেষ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার এক মিনিটেরও কম সময়ে আমি বেশ কিছুটা পেছন দিকে দিয়ে ঘুরে বাংকারের দিকে যাচ্ছিলাম। দেখলাম, আমাদের ফাইবার লাইনগুলো আগুনে পুড়ছে।ওই লাইনগুলো ভার্চ্যুয়াল ককপিট থেকে এন্টেনা এবং স্যাটেলাইটের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এর মাধ্যমে গ্রে ঈগলসে সিগন্যাল পাঠানো হতো এবং ক্যামেরা থেকে পাওয়া ফিডব্যাক আইন আল-আসাদ ঘাঁটির স্ক্রিনে চলে যেত।
কিলপ্যাট্রিক বলেন, ফাইবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেখানে আর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।ফলে সেনারা ড্রোনগুলোর অবস্থান আর খুঁজে পাচ্ছিল না এবং আকাশে-মাটিতে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে কিছু জানতে পারছিল না। তারা ঘটনা সম্পর্কে পুরো অন্ধকারে চলে যায়।ওই সময় কোনো ড্রোনকে ভূপাতিত করা হলেও আইন আল-আসাদে অবরুদ্ধ হয়ে পড়া বাহিনী খবর পেত না। হেরউইগ বলেন, ‘এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। একে তো এটা অনেক ব্যয়বহুল। তা ছাড়া এতে প্রচুর পরিমাণে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যে, আমরা চাই না তা অন্যের হাতে পড়ুক বা শত্রুপক্ষ পেয়ে যাক।’
২০১৯ সালে মার্কিন সামরিক বাজেট অনুসারে, একটি গ্রে ঈগলের দাম ৭০ লাখ মার্কিন ডলার (৫৯ কোটি ২৯ লাখ টাকার বেশি)। ইরাকে মোতায়েনরত মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী ২০১৭ সাল থেকে এটি ব্যবহার করছে।
ইরাকের আকাশে ড্রোন ও উড়োজাহাজ ওড়ানোর জন্য যৌথ বাহিনী ইরাকি সরকারের কাছে সবুজ সংকেত পেয়েছে। তবে ইরান হামলা চালানোর কয়েক দিন আগে ওই অনুমোদনের সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। এরপরও ইরাকের আকাশে ড্রোন চালানো অব্যাহত রেখেছে মার্কিন বাহিনী।
৮ জানুয়ারি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার একপর্যায়ে পাইলটরা বাংকারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তবে হামলা বন্ধ হওয়া মাত্র তার ফের ছুটে গিয়ে গ্রে ঈগলসের সঙ্গে সংযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে। ভোর হলে সেনারা পুড়ে যাওয়া ফাইবারের ৫০০ মিটার পর্যন্ত প্রতিস্থাপন করতে পারে।ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আইন আল-আসাদ ঘাঁটিতে গর্ত তৈরি হয় এবং নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার ফাঁকা পড়ে থাকে। হেরউইগ বলেন, ‘এয়ার ক্র্যাফট অবতরণের জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই আমাদের অন্যত্র অবতরণ করাতে হয়। বাকি এয়ারক্রাফট কোথায় আছে আমরা জানতাম না। ওই সময়টা বেশ উদ্বেগজনক ছিল।’
ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মার্কিন সেনাদের জন্য অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল গ্রে ঈগলকে অবতরণ করানো। উদ্বেগজনক পর্যায়ে জ্বালানি কমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সেগুলোকে আকাশে উড়তে হয়েছিল। পাইলটদের কয়েক ঘণ্টা লেগেছে এক এক করে ড্রোন অবতরণ করাতে। সকাল নয়টায় শেষ ড্রোনটিকে অবতরণ করানো হয়।
আপনার মতামত লিখুন :