গাজী নাসিরুদ্দিন আহমেদ : প্রথম আলোর চাকরিটা হুট করেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। মেজাজ বা মন খারাপ হলে অনায়াসে চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবতে পারতাম। ২০০৪ সালের জুন মাস। কাউকে তো জানাতে হবে। আমি তখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছি। কারওয়ান বাজার থেকে অফিস শেষ করে চানখারপুল গিয়েছি। রাতের খাবারের আগে ভাবলাম আম্মুকে বলি। একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকানে ঢুকে ফোন করলাম। বললাম, আম্মু চাকরি ছেড়ে দেবো।
আম্মু বললো, বাড়ি চলে আয়। আমার মা একবারও বলেননি কেন ছাড়বি, চেষ্টা কর। পরদিন গেলাম ইস্কাটন রোডে শফিক রেহমানের বাড়ির আঙ্গিনায়। অমিতদার প্রজেক্ট অফিস। তিনি যায়যায়দিন বের করার জন্য চুক্তিবদ্ধ। টোকন ভাই, প্রথম আলোর সাবেক চিফ রিপোর্টার আমিরুল ইসলাম ও সঞ্জীবদা, সঞ্জীব চৌধুরীকে নিয়ে অমিতদা শফি ভাইয়ের বাড়ির একটি অংশে অফিস করেন। অমিত হাবিব আমার প্রথম বস। ভোরের কাগজের পরাক্রমশালী সময়ের বার্তা সম্পাদক। তার কাছে বললাম, চাকরি করবো না। তাদের প্রজেক্টের খবর নেই। পত্রিকার অফিস বানানোর জন্য জায়গা ঠিক হয়েছে। কিন্তু ভবন কবে উঠবে তার ইয়ত্তা নেই। লোকজন নিয়োগ তো দূরের কথা। তিনি বললেন, দাঁড়ান। সঞ্জীবদা আমাকে দেখেই বললেন, এটা একটু অনুবাদ করে দে না। শফি ভাই তাদের তিনজনকেই কি কি হাবিজাবি লিখতে দিয়েছেন।
দিলাম অনুবাদ করে। বলে রাখা ভালো, ভোরের কাগজে সঞ্জীবদা ছিলেন ফিচার্স এডিটর। সিঁড়িতে মাঝে মাঝে দেখা হতো। আমরা অফিস করতাম সন্ধ্যার পরে। সঞ্জীবদাকে তখন ঢাকার রাস্তায় কে পায়। তাই দেখা হতো কদাচিৎ। কেন যেন নিজ অধিকারেই আমাকে তুই করে ডাকতেন। খুব খাতির ছিলো এমন নয়। অমিতদার কথা বলছিলাম। বললেন, বাড়ি যাবেন নাকি? বললাম হ্যাঁ। বললেন, ঘুরে আসেন। সম্ভবত পরদিন চাকরি আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে বাড়ি চলে গেলাম। আদরে আপ্যায়নে দিন যাচ্ছে। আমি ঢাকাতে আর যোগাযোগ করি না। ২০-২৫ দিন যাওয়ার পর মনে হলো অমিতদাকে একটা ফোন করি। ফোন করার পর তিনি বললেন, আপনিও নয়। আমি আপনাকে খুঁজছি আর আপনি একটা ফোন নম্বরও দিয়ে যাননি। বললেন, আপনি ঢাকা আসেন। আমি কয়দিন বিরতি দিয়ে জুলাই মাসের শেষদিন ইস্কাটন রোডে এলাম।
তিনি দোতলায় নিয়ে গেলেন। শফি ভাই এটা সেটা জিজ্ঞেস করলেন। নিচে নেমে অমিতদা বললেন, কাল থেকে অফিস শুরু করেন। সেই আমার প্রথম এক মাসের বেকার জীবন শেষ হলো। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে শেষ চাকরি যখন ছাড়ব ছাড়বো ভাবছি তখন আমি অনেক সিনিয়র। চাকরির বাজার ভীষণ খারাপ। তারপরও চাকরির সুযোগ ভাগ্যক্রমে আমার হাতে কেমনে কেমনে যেন থাকে। অমিতদার একটা নতুন প্রজেক্ট এবারও ছিলো। তবে পত্রিকা নাকি বের হবে না। একদিন তার গুলশানের আড্ডায় গেলাম। বললাম, চাকরি ছেড়ে দেবো। তিনি বললেন, ছাইড়েন না। নতুন কিছু ঠিক করেন। আমি বললাম, আপনার প্রজেক্ট হবে বলে মনে হয় আপনার? মানে ধারণা কি? তিনি ভেবে বললেন, মনে হয় হবে। প্রতিমাসে অনেক টাকা লাগে সংসারে। হিসাব করলাম সর্বোচ্চ কতোদিন বেকার থাকতে হতে পারে। আমার স্ত্রী সাহস দিলো। বললো, তোমার চাকরির সমস্যা হবে না। আমি চাকরি ছেড়ে জীবনে তৃতীয়বার বেকার হলাম। মাঝে আরেকবার বেকার হয়েছিলাম পনেরো দিনের জন্য। সেটা অবশ্য আমার দোষে নয়। আমাকেসহ ১০৪ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করেছিলেন শফিক রেহমান। তৃতীয়বারের বেকারত্ব দীর্ঘ হয়েছে। দু’মাস নানা জায়গায় নানা উদ্যোগ নিয়ে কথা হয়েছে। আমি বারবার ভেবেছি, উল্টাপাল্টা কিছু করা যাবে না। এই বয়সে হুটহাট কিছু করা ঠিক হবে না। দরকার হলে আরও কিছুদিন দেখি। কোথাও জয়েন করলাম না।
অমিতদার সঙ্গে মাঝে মাঝেই কথা হয়। তার প্রজেক্ট এগোচ্ছে না। একদিন ফোন করে তিনি বললেন, ক্যাম্প অফিস একটা ঠিক করেছেন। অমিতদা নতুন অফিসে উঠলেন, এপ্রিলের ১ তারিখে। দেশ রূপান্তরের অস্থায়ী কার্যালয়। প্রথম দিন থেকে আমি নিয়মিত যাই। চাকরির বা নতুন প্রজেক্টের অফার দিলে আমি না করে দিই। ১ জুন থেকে নিয়োগ হলো আমার। বাংলা মোটর এলাম আমরা সেপেটম্বর মাসে। পুরো অফিস প্রস্তুত হতে সময় লাগলো নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। আসিফ-ইয়াং পয়েটরা (জুয়েল মুস্তাফিজ) ডামি করলো সপ্তাহখানেক। মালিকপক্ষের চাপ ইলেকশনের আগেই পত্রিকা করতে হবে। অফিস রেডি হওয়ার দু’সপ্তাহের মাথায় অনেক আবশ্যিক লোকবল ছাড়া পত্রিকা প্রকাশের কথা বলায় অনেকে হেসেছিলেন। তবে পরিচিতরা বলতেন, অমিতদা হাওয়ার উপর থেকে কালের কণ্ঠ বের করেছিলেন। তিনি পারবেন। মালিকপক্ষও বলছে একই কথা। আবার সাপ্লিমেন্টও করতে হবে। তপু আর কাশেমের উপর ভর করলাম।
দুজনের চব্বিশ ঘণ্টা করে খাটুনির পর দুটো সাপ্লিমেন্টও হলো। সাতদিনের ডামি করে আত্মবিশ্বাসী আসিফ আর ইয়াং পয়েট গত বছরের এই রাতে দেশ রূপান্তর বের করে ফেললো। আমাদের পত্রিকার অনেক সমস্যা, কোয়ালিটির অনেক ঘাটতি, কিন্তু সংবাদকর্মীদের পরিশ্রম অক্লান্ত। মাহবুব, সুইটি, প্রতীক, রাজীব, পাভেল, লাবলু ভাই, কাশেম, সারওয়ার, রুবেল, জামান, আরিফ, আলতাফ, মামুন আর খোকন ভাইয়ের স্পোর্টস টিমের সদস্যরা বিশেষ করে বন্ধু তুহিন, জগন্নাথ, আনন্দ, লাইজু, পরাগ, শাহেদ, অঞ্চলের টিমসহ সবার নাওয়া খাওয়া ভুলে থাকার কর্মস্পৃহা ঈর্ষণীয়। চট্টগ্রামের ফারুক ভাইয়ের দলসহ দেশ রূপান্তরের কাছে দূরের সবাইকে বর্ষপূর্তির শুভেচ্ছা। পূর্ণ সম্পাদক হিসেবে অমিতদার প্রথম সফল বর্ষপূর্তিতে অভিনন্দন। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :