তরিকুল ইসলাম : ভারতে নাগরিকত্ব বিল পাশের জেরে ধরেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোনে ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আচমকা দেশটিতে সফর বাতিল করেছেন বলে মনে করছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হুসেন ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশিদ। একই সঙ্গে তারা বলছেন, ভারত বাংলাদেশকে বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে উল্লেখ করে যদি আবার সিএবি নিয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনাও করে, এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত অসন্মানজনক।
ভারতের লোকসভার পর রাজ্যসভাতেও ছাড়পত্র পেয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি)। তা নিয়ে বিক্ষোভের মাত্রা বাড়ছে আসম, ত্রিপুরা-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পর এবার ভারত সফর বাতিল করছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। শুক্রবার টোকিও’র কূটনৈতিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। টোকওি সূত্র বলছে, বিক্ষোভে উত্তাল আসামের গুয়াহাটিতেই জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক হওয়ার কথা ছিলো।
অবশ্য ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলছে, তাদের কাছে এই সংক্রান্ত কোনো খবর নেই। তিন দিনের জন্য ১৫ ডিসেম্বর ভারত সফরে যাওয়ার কথা ছিলো শিনজো আবের।
এ নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হুসেন শুক্রবার আমাদের নতুন সময়কে বলেন, দেশটিতে ধর্মকে নিয়ে যে বিলটি পাশ হয়েছে সেটা এক পক্ষীয়। পক্ষভূত বলেই অন্যান্য ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। তাই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) নিয়ে দেশটিতে বিক্ষোভের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। হয়ত নিরাপত্তাজনিত কারণেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী সফরটি বাতিল করেছেন। যদি বাংলাদেশের দুই মন্ত্রীর ভারত সফর বাতিলের সঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল কাকতালীয় না হয়, তবে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, ভারতের সিএবি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল, ভারত ও বাংলাদেশে একেক রকম প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এসব ভিন্ন-ভিন্ন প্রতিক্রিয়াকে একত্রিত করলে বুঝা যায় যে, ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি ইস্যু হিসেবে আর্ভিভূত হয়েছে। কিন্তু এটা বাংলাদেশের সরকার বা জনগণ পছন্দ করে না। সিএবি বিল নিয়ে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হয়েছে বলেই উভয় দেশের সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটেছে। এ জন্যই পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটি বাতিল হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশিদ বলেন, আমি মনেকরি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্ব বহন করে। এই সম্পর্ককে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য একে অপরের প্রতি অযাচিত রাজনৈতিক দোষারোপ ও বিদ্ধেষ ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আশা করবো ভারত আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে না। এর আগেও নির্বাচনি প্রচারণায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এর আগে অনেকবার যথেষ্ট অপমানকর কথাবার্তা বলেছেন এবং আমরা এতে আহত এটি তাদেরকে জানানো দরকার।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ইসরায়েল বিশ্বের যে কোনো দেশের ইহুদিদের নাগড়িকত্ব দিচ্ছে। ভারতও সেটা করুক, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। সিএবি নিয়ে আমাদের বলার কিছুই নাই কিন্তু আপত্তিকর হচ্ছে ভারত বলছে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না বলেই তারা এটি করেছে এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনা করেছে। এটি আমাদের জন্য অসম্মানজনক। এ নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা দরকার। আমাদের প্র্যাকটিকাল অ্যাপ্রোচ নেয়া উচিত এর কনসিক্যুয়েন্স বিবেচনা করে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলেই বাংলাদেশ এ নিয়ে শক্ত কেনো মন্তব্য করছে না বলে মনে করেন মিস্টার তৌহিদ হুসেন। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করবে এটা বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ কেউ আশা করে না। এরকম ঘটনায় সামনের দিকে সম্পর্ক খারাপ হবে বিষয়টি এমনটা ভাববার কারণ নেই। তবে, গুয়াহাটিতে বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের গাড়ি বহরে হামলার বিষয়টি আমাদের টাচ করে, এ্যাফেক্ট করে। ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলেই এসবের সমাধান আসবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে ভারতকে বিশেষ বার্তাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১২ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে কেন্দ্র করে কী কী ঘটছে, সে দিকে গভীরভাবে নজর রাখছি আমরা। ধর্মীয় স্বাধীনতায় শ্রদ্ধা এবং সবার সমানাধিকারই আমাদের দুই গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি।
ভারত সরকার যেন সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা মাথায় রেখে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করে, সে জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শুরু থেকেই সিএবির প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে মার্কিন কংগ্রেসের একটি অংশ। এনআরসি তৈরির পর দেশের সংখ্যালঘুকে নিশানা করতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মোদির সরকার সিএবি পাস করেছে বলে দাবি তাদের।
আপনার মতামত লিখুন :