জুলিয়ান ফ্রান্সিস : আমার বড় ভাই জেমস, ১৯৪৩ সালে এই পৃথিবীতে এসেছিলো কিছু জ্বীনগত শারীরিক সমস্যা নিয়ে। ডাউন সিনড্রোম-জনিত কারণে আরও অনেক সমস্যার পাশাপাশি শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতা ছিলো জেমসের। আর এই সকল প্রতিবন্ধকতার মাঝেই ১৯৯৯ সালে যুক্তরাজ্যের একটি নার্সিং হোমে নিতান্তই অবহেলায় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো জেমস্। মারা গেলো। কারণ যে ডাক্তাররা জেম্সের চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলো তাদের যথেষ্ট সময় বা সদিচ্ছা ছিলো না, যাতে করে তারা জেম্সের শারীরিক সমস্যার মূলে যেতে পারে। কী হয়েছিলো জেম্সের? সামান্য ডায়রিয়া। আর তার জন্য চিকিৎসাও পেয়েছিলো জেমস্। কিন্তু ডাউন সিনড্রোমে ভোগা আমার ভাইটা হোমের কাউকেবোঝাতেই পারেনি যে ডায়রিয়ার পাশাপাশি তার আরও সমস্যা ছিলো। প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর পুরো বিশ্ব যেখানে আর্ন্তজাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করে, আমার ভাই তখন তার কাছের মানুষ নিয়ে পালন করতো তার জন্মদিন। এই দিনটি অনেক কারণেই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। জেম্সের জন্য, পৃথিবীর সকল শারিরীকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য,তাদের না বলতে পারা কথাগুলোর জন্য।
নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো একবার, আমরা কি কখনো এই না বলা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি? একবারও কি ভেবে দেখেছি কী সমস্যা? প্রতিবন্ধকতা বা গল্পগুলো নিয়ে এই মানুষগুলো কিভাবে বেঁচে থাকে? বেশিরভাগ সময়েই একজন প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে দেখা হলে আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতা বা সদিচ্ছার অভাব যে কারণেই হোক না কেন, সেই সাক্ষাৎটি হয় অপ্রস্তুত আচরনের এক সমাহার। আমরা বুঝেই ওঠতে পারি না যে আমাদের কী করা উচিত বা কী বলা উচিত। তাই আজকের এই লেখা, যেখানে আমি চেষ্টা করেছি আমার অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করণীয় ও বর্জণীয় বিষয় তুলে ধরার জন্য। অভিজ্ঞতা, যা আমি পেয়েছি ডাউন সিনড্রোমে ভোগা আমার ভাই ও ছেলের কাছ থেকে। অভিজ্ঞতা, যা আমাকে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার জন্য সাহস ও মনোবল জুগিয়েছে।
১৯৯০-৯১ সালে আরও অনেক মানুষের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে অমরা যখন জাতীয় প্রতিবন্ধী নীতির খসড়া করেছিলাম তখন মনে অনেক আশা ছিলো। কিন্তু যে শম্বুক গতিতে এই নীতিটি পথ চলা শুরু করলো তা থেকেই নীতি-নির্ধারকদের সদিচ্ছার ব্যাপারটি বোঝা যায়। এখনো পর্যন্ত যে কোন সরকারি কাজে বা অনুদানে প্রতিবন্ধীদের জন্য তুলে রাখা অর্থের পরিমাণ শেষের দিকেই থাকে। এতো নিরাশার মাঝে আশার ঘটনা হলো, বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী বিষয়ক ব্যপারগুলোতে একটুহলেও নজর দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন আইন ২০০১’ রদ করা হয়েছে এবং জাতীয় সংসদের মাধ্যমে ‘প্রতিবন্ধী অধিকার সুরক্ষাআইন ২০১০’ সুদৃঢ় করা হয়েছে। আমার কর্মজীবনে আমি দেশে বা দেশের বাইরে যখনই কোনো রকম প্রতিবন্ধী বিষয়ে কাজ করেছি বা কথা বলেছি, চেষ্টা করেছি মানুষটার দিকে নজর দিতে; চেষ্টা করেছি যেন মানবিক দিকটা তার শারীরিক অবস্থা থেকে ওপরে থাকে। আর তাই আমার আশা আমার আজকের এই লেখাটি স্ব-স্ব মন্ত্রনালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে সুপাঠ্য হবে। আমি আরও আশা করছি এই করণীয় ও বর্জণীয়গুলো আমাদের সাহায্য করবে হাজারো না বলা কথাগুলো বুঝে নিতে। তবে শুরু করার আগে একটি কথা জোর গলায় বলতে চাই আর তা হলো প্রতিবন্ধী কারও কাছে গিয়ে আপনি যদি বুঝতে না পারেন কি করবেন তাহলে তাকে অকপটে জিজ্ঞেস করুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর থেকে কার্যকর কোনো ওপায় হয় না।
১.কখনোই ভাববেন না যে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ তার সকল রিপু বা শারীরিক অবস্থা থেকেই প্রতিবন্ধী; আমরা না বুঝেই অনেক সময় হুইল চেয়ারে বসা মানুষটার সাথে মেপে কথা বলি,কানে কম শোনা এরকম কারও সঙ্গে অনাবশ্যক জোরে কথা বলি বা চোখে দেখে না এমন একজন কে পাশের জনের মাধ্যমে কথাবলি। যা কখনই ওই মানুষটার কাছে কাম্য নয়। ২. আপনার সামনে বসা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষটার দিকে তাকান। তার প্রতিবন্ধকতার দিকে তাকালে আপনি কখনই ওই মানুষটাকে দেখতে পাবেন না। ৩.প্রতিবন্ধী কাউকে দেখলে জিজ্ঞেস করুন আপনি তাকে সাহায্য করবেন নাকি আর যদি আপনার দেখে মনে হয় যে ওনার সাহায্য প্রয়োজন তাহলে জানতে চান কীভাবে আপনি সাহায্য করতে পারেন। হয়তো ওই মানুষটি অপরের সাহায্য নিতে লজ্জা পাচ্ছে অথবা সেই মুহূর্তে আপনার সাহায্য তার দরকার নেই। তিনি একবার মানা করলে পরের বার জানতেই চাইবেন না, তা যেন না হয়। ৪. কখনোই বলবেন না ‘আপনার জায়গায় হলে আমি এটা চেষ্টাই করতামনা’। কেননা বস্তুতপক্ষে আপনি কখনোই জানেন না একজন প্রতিবন্ধী কী করতে পারে আর কী পারে না। ৫. কখনোই বলবেন না ‘আমি বুঝতে পারিনা, আপনি কী করে পারেন? আমি তো মারাই যাবো হাঁটতে না পারলে। আপনি ভাবছেন যে আপনি হয়তো তার সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন। বস্তুতপক্ষে আপনার এই কথাটি তাকে ‘অন্যরকম’ ধারণা দিতে পারে। ৬. প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে সাধারণ অন্য দশটা শিশুর মতোই আচরণ করুন। অনেক সময় এমন শিশুরা খারাপ আচরণকরে ফেলে। সে সকল ক্ষেত্রে অন্য দশটা শিশুকে আপনি যেভাবে শেখাতেন তাকেও সেভাবে শেখান। ৭. নিজের পরিচয় দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিন। মনে করেন আপনি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের সাথে দেখা করে শুধু বললেন, ‘হ্যালো’। এতে করে তার পক্ষে আপনাকে চিনে সাথে সাথে জবাব দেয়াটা একটু কঠিন। দেখা হলে বলতে পারেন, ‘হ্যালো, আমার নাম তাসনিম। আপনার সঙ্গে গত সপ্তাহে আমার সাহানার বাসায় পরিচয় হয়েছিলো’।
৮.দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কাউকে ডাকার আগে তার নামটি জেনে নিন। এতে করে আপনি ওনাকে ডাকলে আপনি চট করে বুঝতে পারবেন যে আপনি ওনাকে ডাকছেন। ৯. কখনো ভাববেন না যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কাউকে ‘আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো’ বললে সে অস্বস্তিবোধ করবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা ব্যাপারটি এমনভাবে ভাবেনই না। ১০. হঠাৎ করে কখনো কোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে স্পর্শ করবেন না। অপেক্ষা করুন, দরকার হলে তিনিই আপনার হাত ধরবেন। আপনার হঠাৎ স্পর্শ তাকে ঘাবড়ে দিতে পারে। আপনি ওনাকে ধরে থাকার চেয়ে উনি আপনাকে ধরলে তা ওনার জন্য বেশি সুবিধা জনক হয়। ১১.কখনোই বলবেন না,‘এখানে একটি সিঁড়ি আছে, বলুন একধাপ নিচে বা একধাপ উপরে একটি সিঁড়ি আছে’। উপরে বা নিচে কোথায় পা ফেলতে হবে তা না জানলে তাদের জন্য ব্যাপারটি কষ্টকর হয়ে যায়। এছাড়া গভীর কোনো ধাপ থাকলে তা আলাদাভাবে উল্লেখ করুন। ১২. দরজা কখনো অর্ধেক খুলে রাখবেন না, হয় পুরো বন্ধ করুন বা পুরো খোলা রাখুন। ১৩. দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বলেই যে একজন টেলিভিশন দেখতে পারবেন না, তা ভাববেন না। টিভির কথাগুলো শোনার মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। ১৪. প্রতিবন্ধী কাউকে সব বাইরের কাজ করে দেবেন না। এতে করে তিনি নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বা নগণ্য মনে করতে পারেন। তাকে বাইরের কাজ যেমন; বাজার-সদাই করার ব্যাপারে সাহায্য করুন এবং তিনি করতে চান কিনা তা জানতে চান। ১৫.শারীরিক বা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী একজনের কাছ থেকে বাচ্চাদের সরিয়ে নেবেন না। এতে করে তিনি মনে ভয়ানক কষ্ট পান। এক্ষেত্রে সকলের সুচারু মানবিক আচরণ পারে পরিস্থিতিটিকে সঠিকভাবে সামাল দিতে। ১৬.শিক্ষণ প্রতিবন্ধী কাউকে ভয় পাবার কোন প্রয়োজন নেই। যদি তিনি মানুষের মাঝে থাকেন তার মানে হলো তার মাঝে হঠাৎ হিং¯্র আচরণ করার সম্ভাবনা কম। মনে রাখবেন আপনার একটুখানি অবহেলা এই মানুষটির শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতাকে আরো কষ্টকর করে তুলতে পারে। ১৭.মনে রাখবেন শুধু শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতা আছে মানেই যে মানুষটি সকলের বলা কোন কথা বা অঙ্গীকার ভুলে যাবে তা নয়।
যেমন আমাদের ছেলে নীল (যার এখন বয়স এখন ৪০)- শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তার স্মৃতিশক্তি ও ধীশক্তি চমৎকার। তাই তাদেরকে কথা দেবার সময় চিন্তা করে দিন। ১৮.মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী একজন কি বলতে চাইছে তা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করুন। এটা ভেবে নেয়ার কোন কারন নেই যে ওনার নিজস্ব কোন মতামত বা চিন্তাধারা নেই। ১৯.অযথা ও অযাচিতভাবে উপদেশ দেবেন না। পেশাগত কারণে দরকার হলো আপনার মতামত জানাতে পারেন কিন্তু মনে রাখবেন, অযাচিতভাবে উপদেশ কেউই পছন্দ করে না। ২০.প্রতিবন্ধী শিশুর পিতা-মাতাকে আলাদা করে কোন অনুকম্পা দেখাবেন না। মনে রাখবেন অন্য সকল পিতা-মাতার মত তার শিশুও তার কাছে অমূল্য। ২১.মনে রাখবেন যে সাহায্যই আপনি করতে চান তা অনেক লম্বা সময় নিয়ে বলতে হবে বা করতে হবে। ধৈর্য্য হারাবেন না । ২২.কখনোই একজন মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষকে সামলে চলার কথা বলবেন না। মনে রাখবেন তিনি যদি পারতেন, তবে তিনি তা অবশ্যই করতেন। ২৩.হুইল চেয়ারে বসা একজনকে অচমকা সরাবেন না। এতে করে তার কষ্ট হয়, সাহায্য হয়না। বরং তাকে জানতে দিন আপনার পরবর্তী দিক কোনটি হবে। ২৪.হুইল চেয়ার দিয়ে কাউকে কোথাও নিয়ে যাবার সময় জিজ্ঞেস করুন, যেগতিতে আপনি যাচ্ছেন তা তার জন্য স্বাচ্ছন্দ্যজনক কিনা। মনে রাখবেন বেশী গতি বা কম গতি কোনোটিই তার জন্য আনন্দদায়ক নয়। ২৫.হুইল চেয়ারের হাতল ধরে টান দেবেন না। তা হঠাৎ করে খুলে আসতে পারে। আর চেয়ার ঠেলার সময় পেছন থেকে কথা বলার সময় মনে রাখবেন চেয়ারে বসা মানুষটি আশেপাশের শব্দের জন্য আপনার কথা বা দিকনির্দেশনা নাও বুঝতে পারেন। তাই কথা বলা বা দিক নির্দেশনা দেবার সময় খেয়াল রাখুন।
চেয়ারে বসে থেকে কারো সাথে দাড়িয়ে থেকে কথা বলবেন না। তার চোখ বরাবর আপনিও বসে পড়–ন ও আপনার কথা বলুন। এতেকরে দাড়িয়ে-বসে কথা বলার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিটি এড়ানো যাবে। ২৬.হুইলচেয়ার দিয়ে সিঁড়ি ওঠা-নামানোর ব্যাপারটি আপনার কাছে নতুন হলে চেয়ারে বসা মানুষটিকে জিজ্ঞেস করুন তিনি আপনাকে সবথেকে ভালো সমাধান দিতে পারবেন। ২৭.শ্রবণ প্রতিবন্ধী কারো সাথে কথা বলার সময় খেয়াল করবেন তিনি যাতে আপনার ঠোঁটের নাড়াচাড়া খেয়াল করতে পারেন। আপনি যদি নড়াচড়া করেন বা আলোর বিপরীতে থাকেন তাহলে আপনার ঠোঁট নড়া দেখে কথা বুঝতে মানুষটির কষ্ট হবে। ২৮.কথা বলার সময় অযথা মুখ চোখ বেশী নাড়াচাড়া করবেন না। এতে করে শ্রবণ প্রতিবন্ধী একজনের সমস্যা বৈ উপকার হয়না। ২৯.শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা স্বভাবতই অন্ধকারে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা। তাই সবসময় খেয়াল রাখবেন ওনাদের জন্য যাতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকে। ৩০. শ্রবণ প্রতিবন্ধী একজন মানুষের কথা যদি আপনি না বোঝেন বা ওনার শ্রবণযন্ত্রে কোন আওয়াজ হতে থাকে তাহলে তাকে জানান। যন্ত্র কাজ না করে আওয়াজ করলে তা নিজে থেকে বোঝার কোনো ওপায় তার নেই। ৩১.শ্রবণ প্রতিবন্ধীর কোনো কথা না বুঝলে তা তাকে জানান। শুনতে পারেন না বলে যে তিনি বলতেও পারেন না তা নয়। ৩২. শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের গান শুনতে দিন। তারা শব্দের চলন থেকে শব্দের উচ্চারণ বুঝতে পারে এবং এই শব্দের চলনটি তারা উপভোগ করেন। লেখক : স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় থেকে বাংলাদেশে দারিদ্রতা দূরীকরণ ও প্রতিবন্ধী বিষয়ক নানা প্রকল্পে কাজ করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :