মানবজমিন : মানবপাচার চক্র স্পেনের কথা বলে বাংলাদেশি যুবকদের পাঠিয়ে দিচ্ছে উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ায়। ওই চক্র আলজেরিয়াকে ট্রানজিট বলছে। তারা বলছে সেখান থেকে তারা যাবে মরক্কো। এরপর মরক্কো হয়ে স্পেন। সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের এমনটাই বলছে। এমনকি ট্রেনিং সেন্টারগুলোতেও তাদের একই কথা বলা হচ্ছে। দালালচক্রের এই বক্তব্য বিশ্বাস করাতে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে রাখা হয়েছে বিশ্ব মানচিত্র। তাতে দেখানো হচ্ছে, সম্ভাব্য রুট। দূরত্ব বুঝিয়ে বাতলে দেয়া হচ্ছে স্পেন যাওয়ার কৌশল। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আলজেরিয়াতে যাওয়ার পর মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভাগ্য বদলের আশায় বিদেশ পাড়ি জমানো এই বাংলাদেশিরা।
সমপ্রতি এমন ৪২ বাংলাদেশি বিদেশের মাটিতে আটকা পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের উদ্ধারের জন্য ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডে আবেদন জানিয়েছে ব্র্যাক। সেদেশে আটকে পড়া ৭ যুবকের পরিবারের আর্জির প্রেক্ষিতে গত ৯ অক্টোবর এ আবেদন করে সংস্থাটি। উদ্ধারের আর্জি জানিয়ে ব্র্যাকের কাছে আবেদন করেছে- মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার আলমগীর সিকদার, শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামের শেখ সুমন, একই উপজেলার শামসাবাদ গ্রামের মো. দেলোয়ার, টঙ্গিবাড়ি উপজেলার টোলকায় গ্রামের দেলোয়ার শেখ, একই উপজেলার উত্তর রায়পুর গ্রামের মো. সিদ্দিকুর রহমান, শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার চরআলগী গ্রামের মহসিন, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলার চর বারাগাজী গ্রামের হেলালের পরিবার। প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড থেকে এ ব্যাপারে দূতাবাসকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠিও দেয়া হয়েছে। এছাড়া এই অবস্থা থেকে ইতোমধ্যে দেশে ফিরেছেন ৯ বাংলাদেশি।
এমন বিড়ম্বনার শিকার যুবকরা জানায়, রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের আলজেরিয়া পাঠায়। রিক্রুটিং এজেন্সি জানায়, তারা আলজেরিয়া থেকে মরক্কো হয়ে স্পেন যেতে পারবে। তাদের বলা হয়, প্রতি মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতন পাব তারা। কিন্তু আলজেরিয়ায় আটকা পড়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আলজেরিয়ায় আটকে পড়া প্রবাসী ও তাদের স্বজনরা জানান, উচ্চ বেতন, ভালো কাজের সম্ভাবনা আর সহজ পথে স্পেন প্রবেশের স্বপ্ন দেখিয়ে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশি যুবকদের। স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে মরক্কোতে আটকা পড়েছেন ৪ জন। সেখানেই মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন তারা। আর আলজেরিয়াতে অবস্থা করছেন এখনও ৪২ বাংলাদেশি।
আলজেরিয়া ফেরত কর্মী মোহাম্মদ ফারুক জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জনপ্রতি ৩লাখ টাকা নিয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ছাড়পত্র দিয়ে মুন্সিগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকার ৫৬ জন বাংলাদেশীকে আলজেরিয়াতে পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সি বন্যা বিজয় ওভারসীজ লি. ও সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টার। আলজেরিয়া যাওয়ার পূর্বে সিঙ্গাপুর ট্রেনিং সেন্টার থেকে কর্মীদের বলা হয়, ভালো না লাগলে কয়েকদিন কাজ করে চাইলে স্পেন চলে যেতে পারবেন। কিন্তু আলজেরিয়াতে গিয়ে কাজ করলেও ঠিকমতো বেতন পাননি তারা। এসব কর্মীদের অভিযোগ, বেতন চাইলে মারধর করা হতো। আলজেরিয়ায় আটকে পড়া ও ফেরত আসা যুবকরা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি ও সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এজেন্সি বলছে, বিদেশ পাঠানোর কথা আমরা পাঠিয়েছি। এখন সেখানে সমস্যা থাকলে কী করবো। সিঙ্গাপুর ট্রেনিং সেন্টারে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, আলজেরিয়াতে তাদের লোক আছে। তারা স্পেনে লোক পাঠায়। আপনারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্পেন চলে যেতে পারেন। এসব কথা শোনার পর তাদের সঙ্গে থাকা ৪ কর্মী আক্তার মিয়া, ইব্রাহিম, রিপন মোল্লা ও উজ্জল স্পেন যাওয়ার উদ্দেশ্যে আলজেরিয়া থেকে মরক্কো গেছেন। কিন্তু মরক্কো গিয়ে বিপদে পড়েছেন তারা।
সমপ্রতি ফেরত আসা ফারুক জানান, পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় তিনিসহ ৯ জন দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এরা হলেন, জসিম, মুহিন আহাম্মেদ, শামীম শেখ, হৃদয় শেখ, মো. সুমন, রুবেল, ইসমাইল ও আল আমিন। তারা জানান, জীবন বাঁচানোর তাগিদে পরিবার থেকে টাকা নিয়ে বিমানের টিকিট কেটে শুন্য হাতে দেশে ফিরে এসেছেন। দেশে ফেরত আসার পর কর্মীরা সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি বন্যা বিজয় ওভারসীজ লি. ও সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যোগাযোগের পর থেকেই তাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে মরক্কো থেকে দেশে ফেরত আসা দুই কর্মী রায়হান ও মো. ওমর ফারুক জানান, ২০১৭ সালে রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স আর এস লিংকার্স তাদেরকে জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র দিয়ে আলজেরিয়া পাঠান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তারা মরক্কো হয়ে স্পেন যাওয়ার চেষ্টা করেন। এছাড়া একইভাবে আলজেরিয়া থেকে মরক্কো হয়ে স্পেন যেতে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফেরত এসেছেন মো. মিজানুর রহমান, মো. মহিউদ্দিন ও মো: রায়হান। তারাও একই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছেন।
আর.এস লিংকার্স লিমিটেডের ডিরেক্টর লুৎফর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা আলজেরিয়াতে কোন লোক পাঠাইনি। তাছাড়া আমরা বিদেশে কোন লোক পাঠাই না। শুধু প্রসেসিং করি। তাহলে আপনাদের কথা বলা হচ্ছে কেনো, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেশ কিছু দিন আমি অফিসে যাই না। আপনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর লোকমান খানকে ফোন করে জানতে পারেন। কিন্তু লোকমান খানের নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে, বন্যা বিজয় ওভারসিজ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ড. বরুণ দেবনাথের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে ব্র্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, আলজেরিয়াতে আটকে পড়া ৭ জনের পরিবার আমাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। দেশটিতে অবস্থানরত ওই বাংলাদেশিদের নিরাপদে দ্রুত দেশে ফেরত আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে গত ৯ই অক্টোবর আমরা লিখিতভাবে আবেদন করেছি। বোর্ড থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে। তিনি বলেন, সার্বিক ঘটনা শুনে আমাদের মনে হচ্ছে, স্পেনে পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে আলজেরিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। দ্রুত এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করতে না পারলে আরও অনেককে বিপদে পড়তে হবে। অনুলিখন : মাজহারুল ইসলাম, সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব
আপনার মতামত লিখুন :