আমাদের সময় : শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের নামে খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রাণঘাতী ফরমালিন প্রস্তুতের অন্যতম কাঁচামাল ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ কেমিক্যাল। মুন্সীগঞ্জের ‘সুপার বোর্ড মিলস লিমিটেড’ থেকে ৬২৭ টন ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ বিক্রির সত্যতা পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে ভয়ঙ্কর এ তথ্য উঠে এসেছে। গোপন ওই প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ২৫ জুলাই সুপার বোর্ড মিলস লিমিটেড স্পেন থেকে ২০টি কনটেইনারে ২০০ টন ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ আমদানি করে। কিন্তু এর আগে আমদানি করা ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ খোলাবাজারে বিক্রির গোপন তথ্য পেয়ে এনবিআরের মাধ্যমে চালানটির খালাস সাময়িকভাবে বন্ধের পর অনুসন্ধান শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত বিভাগ। এর পর ওই বছরের ২৬ আগস্ট শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ সফিউর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সুপার বোর্ড মিলস লিমিটেডসহ চারটি পার্টিকেল বা হার্ড বোর্ড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ আমদানি ও পণ্য উৎপাদনের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায়। একই সঙ্গে রাসায়নিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তদন্ত দল ওইসব প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন পরিদর্শন করে।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া শিকিরগঞ্জে অবস্থিত সুপার বোর্ড মিলস লিমিটেড কারখানা পরিদর্শন ও মেশিনের কার্যক্ষমতা, ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ ব্যবহারের অনুপাত এবং অন্য দলিল যাচাই করে ৬২৭.৭২ টন খোলাবাজারে বিক্রির সত্যতা পাওয়া যায়।
‘প্যারাফরমালডিহাইড’ রূপান্তর/বিশ্লেষণ-রূপান্তর প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক পরীক্ষার গবেষণায় উঠে আসে ৩৫-৪০ গ্রাম প্যারাফরমালডিহাইডকে ৬৫-৭ গ্রাম পানি যোগ করে ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে বিয়োজিত হয়ে ফরমালিন তৈরি হয়। রাসায়নিক পরীক্ষায় বলা হয়, সুপার বোর্ড মিলসের খোলাবাজারে বিক্রীত ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ বিক্রি করে ১৭০০ টন ফরমালিন উৎপাদন সম্ভব হয়। ৪ হাজার কেজি প্রতি ব্যাচের গ্লু/আঠা তৈরিতে ১১২২ কেজি ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ ব্যবহৃত হয়। প্রতি ব্যাচ গ্লু তৈরিতে ৪ ঘণ্টায় ২১.৪৪ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়।
কারখানাটির আমদানিচিত্রে দেখা গেছে, ২০১৩-১৬ তিন অর্থবছরে ২০ লাখ ৬২ হাজার ৭শ ৬৭ কেজি ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ আমদানি করা হয়েছে। এ সময়ে সুপার বোর্ড মিলে ২৭ হাজার ৪শ ২১ দশমিক ৮০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়। সে হিসাবে ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ ব্যবহৃত হয়েছে ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪০ কেজি। এতে প্রমাণিত ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭শ ২৬ কেজি অব্যবহৃত ছিল। সুপার বোর্ড মিলের দাবি ছিল, ২০১৪ সালের ১৯ জুন কারখানায় এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১ লাখ ৮০ হাজার কেজি ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। তদন্ত দল সুপার বোর্ডের মজুদ খাতা দেখে জানতে পারে, ২০১৪ সালের ১৮ জুন পর্যন্ত কোম্পানির খাতায় মজুদের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ১৪৮ কেজি প্যারাফরমালডিহাইড। একই বছরের ১ জুলাই হিসাবের খাতা বলছে সমপরিমাণ সেখানে মজুদ ছিল। সে হিসাবে কোনো ভস্মীভূত হয়নি। এ ছাড়া আমদানি করা ২০ লাখ ৬২ হাজার ৭শ ৬৭ কেজি ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ দিয়ে পণ্য উৎপাদনে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যয় হওয়ায় কথা ছিল, সে পরিমাণ ব্যয় হয়নি। অবৈধপথে বিক্রি করা এ ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭শ ২৬ কেজি রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত ১৭০০ টন ফরমালিন কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, সে হিসাবও নেই কারও কাছে।
এনবিআরে পাঠানো শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ থেকে নির্দিষ্ট অনুপাত পানি মিশিয়ে ফরমালিন তৈরি হয়। এর অতিরিক্ত ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। সহজে মিশ্রণের মাধ্যমে ফরমালিন উৎপাদন করায় খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় এ বিপুল পরিমাণ ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ দেশের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
প্যারাফরমালডিহাইড ফরমালিনেরই ভিন্ন রূপ। ফরমালিনের এ রকম ১৫টি নাম রয়েছে। প্যারাফরমালডিহাইডের সঙ্গে পানি মিশালেই তা ফরমালিনে রূপ লাভ করে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের গবেষণা বলছে, ফরমালিন মানবদেহের সংস্পর্শ এলে নাক, ফুসফুস ও গলায় ক্যানসার উৎপন্ন করে।
বাংলাদেশে বোর্ড উৎপাদন বা শিল্প কারখানায় ব্যবহার, পচনশীল বস্তু সংরক্ষণে ফরমালিন আমদানির অনুমতি রয়েছে। তবে অসাধু চক্র খোলাবাজার থেকে ফরমালিন কিনে মাছ, ফল, সবজিসহ পচনশীল খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করায় প্রাণহানিকর রোগের উৎপাদক হচ্ছে ‘প্যারাফরমালডিহাইড’।
সূত্র বলছে, ফরমালিন উৎপাদনে ব্যবহৃত ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ আমদানিকারক অন্যতম চারটি বোর্ড মিলকে আমদানি ও উৎপাদনের তথ্য চেয়ে চিঠি দিলেও এনবিপি কোয়ালিটি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কোনো তথ্য দেয়নি। এমন ছোট-বড় ২৮টি প্রতিষ্ঠানের ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ ব্যবহারের বিষয়ে তদন্ত চলছে। অনুলিখন : তন্নীমা আক্তার, সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব
আপনার মতামত লিখুন :