মোস্তফা ফিরোজ : রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাক এই প্রশ্নে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু সম্প্রতি বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের এই অবস্থানের স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার চীনা উদ্যোগ ব্যর্থ হবার পর নতুন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে সেখান থেকেই। নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত যেতে রাজি হয়নি। ২৪ আগস্ট তারা কক্সবাজারে একটি বিশাল সুশৃঙ্খল সমাবেশ করে। সেখানে তারা রাখাইনে ফেরত যাওয়া প্রশ্নে পাঁচ দফা দাবি জানায়। এই দাবি পূরণ ছাড়া তারা ফিরে যাবে না বলেও ঘোষণা করে।
এই সমাবেশের পরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শুর হয় রোহিঙ্গা বিরোধী প্রচারণা। কেন রোহিঙ্গারা এতো বড় সমাবেশ করলো, কে অনুমতি দিলো, বাংলাদেশে তারা থাকার পাঁয়তারা করছে কিনা এসব প্রশ্ন তোলা হলো। আরও প্রশ্ন উঠলো, এই সমাবেশে অর্থ যোগালো কে, ডিজিটাল ব্যানার কোথায় পেলো, এতো সিম আর মোবাইল, চকচকে পোশাক-আশাক কোথা থেকে আসলো? সবচেয়ে বড় ভিলেন বানানো হলো সমাবেশের মূল উদ্যোক্তা মুহিবুল্লাহকে। বলা হলো এই সেই লোক যে কিনা প্রিয়া সাহার মতো ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। কীভাবে মুহিবুল্লাহ আমেরিকা গেলো, আবার দেশেও ফিরে আসলো এসব নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া সরব হয়ে উঠলো। ফলে হারিয়ে যেতে থাকলো নির্যাতিত নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে তাদের দেশে ফিরে যাবার ইস্যুটি। দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে যেখানে মিয়ানমারকে চাপে রাখার কথা সেখানে উল্টো গণহত্যা ও গণধর্ষণের শিকার এই জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার প্রচারণা জোরেশোরে শুরু হয়েছে। ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যার্পণ নিয়ে চরম প্রহসন করেও চীন মিয়ানমার পার পেয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের ভূমিকা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে নিরাপদে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। কফি আনান কমিশনের এ সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়িত করতে হবে।
এটাই আন্তর্জাতিক বিশ্বের দাবি। এই দাবির বিষয়ে চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপানের কেবল ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই কয়টি দেশের এই অবস্থানের কারণে মিয়ানমার পার পেয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরানোর রাস্তাটি জটিল হয়ে পড়ছে। তার বড় প্রমাণ হলো কোনো শর্ত ছাড়াই রোহিঙ্গাদের ২২ আগস্ট রাখাইনে ফেরত পাঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রতিবাদ বিক্ষোভ করবে। এটা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষেরা এভাবেই গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ জানিয়ে থাকে। ফলে বড় সমাবেশ করে তারা যদি শক্তি প্রদর্শন করে তাতে মিয়ানমার বা তার সহযোগীরা বিক্ষুব্ধ হতে পারে, আমরা কেন সেই ফাঁদে পা দিয়ে একই সুর তুলবো? রোহিঙ্গাদের সাহায্য-সহযোগিতা করছে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক দাতা দেশ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। এখানে এনজিও ষড়যন্ত্র খোঁজা হচ্ছে কেন? তারাও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা নীতির কোন অংশের বিরোধিতা করছে? জীবন জীবিকার নিরাপত্তা নিয়ে রোহিঙ্গারা দেশে ফিরুক এটা যেমন বাংলাদেশ চায়, তেমনটা চায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বিশ্ব সম্প্রদায়। এখানে সমস্যাটা কোথায়? বলা হচ্ছে ওই এলাকা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সত্য। কিন্তু কি করার আছে? এর জন্য কি রোহিঙ্গারা, না মিয়ানমার দায়ী। দীর্ঘদিন রোহিঙ্গারা অবস্থান করলে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকবে। সেটাও সত্য। তাহলে সমাধান কি জোর করে তাদের মিয়ানমারে বিতাড়িত করা? নাকি মিয়ানমারের উপরে জোর চাপ তৈরি করে তাদের ফেরত পাঠানো? আমার মনে হয়, ঠা-া মাথায় ভাবা দরকার। আমরা যেন বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ডুবে না যাই। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন করে যে অপরাধ করেছে, আমরা যেন এই জনগোষ্ঠীর উপরে বিক্ষুব্ধ হয়ে পাল্টা ভুল না করে বসি। সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :