অসীম সাহা : কোন্ পথে যাচ্ছে বরগুনার রাজনীতি? রিফাত-হত্যাকে কেন্দ্র করে কিছুদিন জাতীয় রাজনীতি, সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল এবং স্যোসাল মিডিয়া এতটাই সরব ছিল যে, অন্য কোনও বিষয়ই সেখানে প্রধান হয়ে উঠতে পারেনি। বিগত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে অসংখ্য মানুষের সামনে ফিল্মি স্টাইলে রিফাত শরীফ নামক এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে-দৃশ্যের ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে ভাইরাল হলে সারাদেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদের ঝড় উঠতে থাকে সর্বত্র। এমন নৃশংশ খুনের ঘটনা মানুষকে হতচকিত করে দেয়। প্রথমদিকে এটিকে রাজনৈতিক প্রলেপ দিয়ে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল একটি পক্ষ। এরপর আসে মাদকঘটিত দ্বন্দ্বের কথা।
নয়ন বন্ড নামক মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী এর সঙ্গে প্রধানভাবে জড়িত, এমন অভিযোগও সামনে চলে আসে। তবে রিফাতকে উপর্যুপরি অস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত করার সময় একটি মেয়ে তাতে বাধা দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়ার পর বেরিয়ে আসে আর এক নাটকীয় কাহিনি। জানা যায়, নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সঙ্গে ছিলো নয়ন বন্ডের প্রেমের সম্পর্ক! মিন্নির সঙ্গে তার নাকি বিয়েও হয়েছিল। সেই বিয়ের বিচ্ছেদ না ঘটিয়েই মিন্নি রিফাতকে বিয়ে করায় সেই ক্ষোভ থেকে নয়ন রিফাতকে হত্যা করতে পারে, এমন কথাও শোনা গিয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে খুনের বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। নয়ন বন্ডই যে প্রকৃত খুনি, তাতে কারও কোনও সন্দেহ থাকে না। কিন্তু প্রথম থেকেই নয়ন বন্ডের খুনের ঘটনাকে আড়াল করতে নেপথ্যে কিছু রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী নেতা তাকে রাজনীতির মোড়কে পরিবেশন করার প্রয়াস অব্যাহত রাখে। আর এর সঙ্গে আওয়ামী লীগেরই প্রতিপক্ষ এক শ্রেণির নেতা একে অপরের ওপর দোষারোপ করতে শুরু করেন।
ঘটনার শুরু থেকেই হত্যাকা-ের জন্য দায়ী নয়ন বন্ডের গড ফাদার হিসেবে বরগুনা আওয়ামী লীগের সভাপতি, পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের নাম সামনে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সুনামের পরিবার তা সবসময়ই অস্বীকার করেন। তারা প্রশ্ন তোলেন, যারা এ-ধরনের কথা বলছে, তারা প্রমাণ করুক, সুনাম এর সঙ্গে জড়িত। আসলে তাদের অভিযোগ, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়াকে তারই হাতে তৈরি কিছু কিছু নেতা মেনে নিতে পারেননি। তারা চান বদলানো হোক প্রার্থী। এর মধ্যে কিছু আছে, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে অনেক বিত্তবিভবের মালিক হওয়া উচ্চাভিলাষী নীরব সাম্প্রদায়িক প্রতিপক্ষ, যারা এখন আর বৃহত্তর মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলে সংখ্যালঘু সংসদ সদস্যকে দেখতে চান না! এর সঙ্গে উপরিস্তরের সরকারি ছাত্র সংগঠনের কিছু নেতাও জড়িত আছেন বলে অভিযোগ আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে বারবার মনোনয়ন দিচ্ছেন, তিনি কি কিছু না জেনেশুনেই তা দিচ্ছেন? প্রতিপক্ষ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর স্বেচ্ছাচারিতা, নিজের ছেলেকে সংসদ সদস্য হিসেবে ভবিষ্যতের প্রার্থী করার জন্য প্রস্তুত করা এবং এমনকি নারীঘটিত কেলেংকারীর অভিযোগও তোলা হয়েছে। এটা মারাত্মক অভিযোগ। বরগুনার মতো একটি ছোট্ট শহরে একজন সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সভাপতি এত বছর ধরে এমন কুকীর্তি করে গেল, অথচ বরগুনার আমজনতা, দেশবাসী কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুই জানলেন না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ঘটনা যদি সত্যি হয়, তা হলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এখন যারা শম্ভুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তারা কেন আগে তা করেননি? শরীফহত্যায় জড়িত নয়ন বন্ডের নাম চলে আসাতে কাদের প্ররোচনায় তাকে ক্রশফায়ারে হত্যা করা হল এবং তার মুখ থেকে সত্যি বের হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হল, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন সকলকে তাড়িত করছে। এর সঙ্গে কি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু জড়িত কিংবা তার ছেলে সুনাম দেবনাথ? তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই নয়ন বন্ড ফিনিস। অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন, নিজের পুত্রকে বাঁচনার জন্য শম্ভু নয়ন বন্ডকে ক্রশ ফায়ারে পাঠিয়েছে। তা হলে তো অভিযোগের তির নিক্ষিপ্ত হবে বরগুনার অইনশৃক্সক্ষলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। তারা সত্য লুকানোর জন্য একজন এমপির কথায় প্রধান আসামী নয়ন বন্ডকে মেরে ফেললে সেটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। সত্য উন্মোচনের জন্য কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের একটি দলকে বরগুনায় পাঠানো জরুরি বলে আমি মনে করি। যদি অভিযোগ সত্যি হয়, তা হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন, এটা সকলেরই প্রত্যাশা। কিন্তু তা না হয়ে যদি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে ফাঁসানোর জন্য এবং তার পুত্র সুনাম দেবনাথকে ভবিষ্যৎ-রাজনীতির মাঠ থেকে উৎখাতের জন্য এই অভিযোগ উত্থাপন করা হয়ে থাকে, তা হলে তাদের বিরুদ্ধেও নেত্রীকে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, রিফাতকে হত্যা করেছে নয়ন বন্ড এবং তার সহযোগীরা। সেখানে নয়নের মূল শক্তি ছিলো শম্ভু দেবনাথের প্রতিপক্ষ। তাদের নেপথ্যের যারা কুশীলব, তার হত্যকারীদের নিকটতম আত্মীয়ও। নয়ন বন্ড কাদের লোক ছিল, সেটা বরগুনাবাসীর জানা। তাদের মধ্যে বরগুনার বহুল পরিচিত একজন নেতা আওয়ামীবিরোধী সেন্টিমেন্ট ও ভোটব্যাংককে পুঁজি করে ২০০১ থেকে পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে শম্ভু দেবনাথের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শুধু ২০০১-এর বিতর্কিত নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এ-নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ২০১৬-এর জেলা পরিষদের নির্বাচনে তৎকালীন এ নেতার দুর্নীতিকে সামনে এনে এবং আর কখনও নৌকার বিরোধিতা না করার শর্তে একটি বড় প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে তাকে বসানো হয়। কিন্তু নির্বাচিত হয়েই তিনি শর্তভঙ্গ করে আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি শুরু করেন। বরগুনায় যেখানে শম্ভু দেবনাথের পূর্বের এক বড় নেতার সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক, সেখানে সেই লোক নিশ্চয়ই সুনাম দেবনাথের বন্ধু কিংবা শিষ্য হতে পারে না। চোখকান একটু খোলা রাখলেই এটা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
আসলে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বরুগুনার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শম্ভুবিরোধী একটি জোট গড়ে তুলেছিলেন জেলার একেবারে উচ্চস্তরের কিছু অতি উৎসাহী আওয়ামী লীগ নেতা। সেখানে অর্থ যোগানদাতা হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী সদস্যের নামও আলোচনায় এসেছে। শোনা যাচ্ছে, শম্ভু দেবনাথ নৌকার মনোনয়ন পেয়ে পুনরায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে এলেও বিরোধী জোটটি সম্মিলিতভাবে আগের চেয়েও বেশি তৎপর হয়ে রয়েছে। তারই সর্বশেষ সংযোজন রিফাত হত্যাকা-ে শম্ভু ও সুনামকে জড়ানো!
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়াও যায়, রিফাত শরীফ হত্যাকা-ের নেপথ্যে এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ জড়িত, তাহলে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া সবারই তার অনুসারী হওয়ার কথা। কিন্তু নয়ন বন্ডের সহযোগীরা এমপির প্রতিপক্ষের হওয়া সত্ত্বেও কি এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের হয়ে কাজ করার কথা? সাধারণভাবে দেখলেই তো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
আসলে বরগুনায় ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবং তার ছেলেকে ফাঁসাতে, হেয় প্রতিপন্ন করতে, তার ব্যক্তিইমেজ নষ্ট করতে এবং তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনকে কলুষিত করতে এ-ধরনের ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতা হয়েছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। ইদানীং রিফাত হত্যাকা- ভিন্নদিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। তা থেকে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল।
বাবার প্রশ্রয় এবং প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সুনাম দেবনাথ হত্যাকা-ের তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করছেন বলে কিছু প্রচারমাধ্যমে যে খবর প্রচারিত হয়েছে, তাও এখন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। একটি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে শম্ভু দেবনাথ ১০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলাও করেছেন।
স্থানীয়রা আরেকটি বিষয় জানিয়েছেন, যাতে মনে হয়, শম্ভু এ-হত্যাকা-ের পর ভিকটিম হয়েছেন। তাদের কথায়, নিহত রিফাত শরীফ এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শম্ভু দেবনাথের হয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনায় যুক্ত ছিল। তার এমন মৃত্যুকে মেনে নেয়া শম্ভুর পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক ছিল। তাই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে প্রথম সামাজিক যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন সুনাম দেবনাথ, সে- ডাকে সাড়া দিয়ে বরগুনায় রাস্তায় নেমে এসেছিল হাজারও মানুষ। এ-বিষয়টি কি শুধুই লোকদেখানো? যদি হয়, তা প্রমাণ করার দায়িত্ব প্রতিপক্ষের।
সবশেষে একটি প্রশ্ন করা যেতেই পারে, শম্ভু দেবনাথ, গত ৩০ বছর শীর্ষপর্যায়ে রাজনীতি করে কখনই ইমেজসংকটে না পড়লেও গত এক বছরে তাকে নিয়ে এমন স্পর্শকাতর প্রশ্ন করছেন কারা এবং কেন? তার সংসদীয় এলাকায় এতবড় একটি হত্যাকা- ঘটে গেল, তার জন্য শম্ভুকে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতেই পারে। সভাপতি হিসেবে তিনিও এর দায় এড়াতে পারেনা না। তাই তার উচিত অবিলম্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুরো বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিকার চাওয়া এবং এ-ধরনের অপপ্রচারকে প্রতিহত করে যাতে রিফাত হত্যায় সত্যিকার দোষীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তা বিধান করা যায় এবং পুনরায় নিরাপদ ও সুখকর বরগুনা উপহার দেয়া যায়, তার জন্য শক্ত ভূমিকা পালন করা। একুশেপদকপ্রাপ্ত কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :