১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বাঙালি জাতির জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়। সপরিবারে হত্যা করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৪২ বছর পরও তার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা শেষ হতে চায় না; মনে হয় আবার নতুন করে খুঁজতে গেলে যেন নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যাবে, কিংবা পাওয়া যাবে নতুন কোনো সম্পৃক্ততা। ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের নানা দিকে নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ কথা বলেন প্রিয়.কম এর সঙ্গে। সাক্ষাতকারটি নেয়া হয় ২০১৭ সালে। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় আমাদের সময়ের ডটকমের পাঠকদের জন্যে তা ফের পরিবেশন করা হলো।
১৫ আগস্টের ঘটনা নিয়ে বহু বিশ্লেষণ হয়েছে, আপনার কাছে জানতে চাইবো- একটি দেশের রাষ্ট্রপতি এবং জাতির এত বড় একজন নেতাই শুধু নন; বাঙালি জাতির পিতা তিনি, তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনএসআই’, ‘ডিজিএফআই’ কিংবা ৩২ নং বাড়ির নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা সামরিক বাহিনী- তারা এ বিষয়ে কিছুই জানলো না, কোনো অ্যাকশনে যাওয়ার আগেই ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো, এটা কীভাবে সম্ভব?
মহিউদ্দিন আহমদ: ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুকে বেশ কয়েকবারই বলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, কিন্তু এর জবাবে উনি সব সময় বলতেন- আমাকে কোনো বাঙালি মারতে পারে না। যেহেতু তিনি জননেতা, উনার সাথে যে কেউ-ই গিয়ে দেখা করতে পারতো। তিনি ৩২ নং বাড়িতেই থাকতেন, আর সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও তেমন জোরদার ছিল না। তার নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিল, তারা তো তাদের দায়িত্বটুকু পালন করেনি। রাষ্ট্রপতি তো নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজে করবেন না। তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক নিয়োগ আছে, তারা সেই কাজের জন্য বেতন-ভাতা পেতেন, তারা কেনো নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো?
সেনাবাহিনীর কোন্দল কী এই ঘটনার মূল?
মহিউদ্দিন আহমদ: সে সময় সেনাবাহিনীতে নানা উপদলীয় কোন্দল ছিল, শৃঙ্খলা ছিল না, সচিবালয়েও শৃঙ্খলা ছিল না। নানান রকম দলাদলিতে বিভক্ত ছিল ছাত্ররা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও বিভেদ দেখা দেয়, একে অপরের প্রতি নানা রকম ক্ষোভ নিয়ে চলছিল তারা। আওয়ামীলীগ এবং তার মিত্র বলতে তখন ছিল শুধু সিপিবি আর ন্যাপ, এর বাইরে সমস্ত রাজনৈতিক দল হচ্ছে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে। এখন তো শুধু জাসদের কথা বলে, শুধু জাসদ না, সিপিবি আর ন্যাপ ছাড়া প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল তাদের বিপক্ষে ছিল। এ অবস্থার মধ্যে এক রাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই রকম নিখুঁত ফুল প্রুফ অপারেশন হলো; একটুও পান থেকে চুন খসল না, এবং ঘাতকরা তাদের টার্গেটকৃত পরিকল্পনা সফল করে চলে গেল। এটা সম্ভব হয় তখনই যখন রাষ্ট্রের বড় বড় এজেন্সিগুলোর প্রশ্রয় বা সমর্থন থাকে। এই ঘটনাকে আমি কখনোই কয়েকজন বিপথগামী জুনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের কাজ হিসেবে বিবেচনা করবো না, দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, এর পেছনে পুরো সশস্ত্রবাহিনীর হাত ছিল বলে আমি মনে করি। পুরো সশস্ত্রবাহিনী এই ঘটনাকে সমর্থন করেছিলো বলেই এই ঘটনার পর সেনাবাহিনীকে কোনো অ্যাকশন নিতে আমরা দেখিনি।
শুধু কি সেনাবাহিনীর ভূমিকা? সে সময়ের মন্ত্রীরাও তো খন্দকার মোশতাকের ক্যাবিনেটে রাতারাতি যোগ দিয়েছিলেন?
মহিউদ্দিন আহমদ: গুটি কয়েক আওয়ামীলীগের নেতা এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি, তারা গ্রেফতার হয়েছিলেন। কারাগারে চার নেতা তো নিহতও হলেন। কিন্তু অধিকাংশ নেতাদের কথা যদি বলেন- তারা এর কোনো প্রতিবাদই করেননি। বরঞ্চ তারা গদ্গদ হয়ে গিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক সরকারের মন্ত্রী হতে। এখন তাদের অনেকেই বলেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় তারা প্রাণের ভয়ে যোগ দিয়েছিলেন। কয়েকজনকে গান পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এটা সত্যি। কিন্তু সবাইকে গান পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল- এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ পরবর্তীতে যখন মোশতাক সরকারের পতন হয়, আর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন- সে বিএনপিতে আওয়ামীলীগের নেতারা যোগ দিলেন কেনো? এই যে অধ্যাপক ইউসুফ আলী, যিনি মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন, তিনিও তো জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হয়েছেন। তারপরে বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটের সদস্য সোহরাব হোসেন; তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন, মন্ত্রী হওয়ার জন্য গিয়েছিলেন কিন্তু তাকে শপথ পড়ানো হয়নি। আরো আছেন- রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, উনি মন্ত্রী হয়েছিলেন, কে এম ওবায়দুর রহমান মন্ত্রী হয়েছিলেন। এখন তারা যদি বলেন খন্দকার মোশতাক তাদের বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তুলে নিয়ে গেছেন, তাহলে তারা জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হলেন কি করে? আওয়ামীলীগের একটা অংশ পরিবর্তন চাচ্ছিলো, এবং ১৫ আগস্টের এই ঘটনায় যে তাদের অনেকেই খুশি হয়েছে, এটা তো তাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে বোঝাই যায়। এ রকম একজন লোক হলেন মালেক উকিল, তিনি স্পিকার ছিলেন। ওই সময় লন্ডনে গিয়ে তিনি বলেছিলেন- ফেরাউনের পতন হয়েছে! এরপরে কীভাবে আওয়ামীলীগের লোকজন আবার তাকে তাদের দলের সভাপতি বানায়? একটা দল কতটুকু দেউলিয়া হলে এবং ডিমোরালাইজড হলে এই ধরনের লোককে সভাপতি বানাতে পারে।
তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন কে এম সফিউল্লাহ, একজন সেনা প্রধান হিসেবে উনার সে সময়ের নীরব ভূমিকা অত্যন্ত প্রশ্নবোধক। অনেকেই বলে থাকেন এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তিনি আগে থেকেই অবগত ছিলেন।
মহিউদ্দিন আহমদ: এটা যদি উনি এখন বলেন যে আগে থেকে কিছুই জানতেন না, তাহলে তো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণেই উনার বিচার হওয়া উচিৎ হবে। উনি জানবেন না কেনো, তার কাজটা কী? সুতরাং আমি জানতাম না- এই কথা বলে তো পার পাওয়া যাবে না। এই ঘটনা ঘটার পর তো ই্মিডিয়েটলি উনি পদত্যাগ করতে পারতেন, উনি তো ওয়েট করেছেন যতদিন না তাকে সরিয়ে অন্য আরেকজনকে সেনাপ্রধান করা হয়। নতুন সেনাপ্রধান হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের পরও তো সফিউল্লাহ সাহেব দীর্ঘদিন সেই সরকারের অধীনে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। আর এখন বলেন- ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না, এই গল্প তো মানুষ বিশ্বাস করবে না।
রাষ্ট্রের সকল সশস্ত্রবাহিনী এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জানতো; নীরব ছিল বা প্রশয় দিয়েছে বুঝলাম, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া রক্ষীবাহিনী কেনো নীরব ছিল? কেনো তারা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো না?
মহিউদ্দিন আহমদ: রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল মূলত বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালান দমন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তার জন্য। মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এটা গড়া হয়েছিল। এটা কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল না, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ছিল এর কর্মকাণ্ড। এখন কথা হচ্ছে বিপদের সময় কেনো তারা কাজে আসলো না? তাদের একটা ইউনিট ছিল শের-ই-বাংলা নগরে, আর পুরো শক্তিটা ছিল সাভারে। এখন তারা বলে কর্ণেল ফারুক নাকি সেখানে দুটি ট্যাঙ্ক নিয়ে গিয়েছিলেন, ট্যাঙ্কের ভয়ে তারা কিছু করতে পারে নাই। এই গল্প কী বিশ্বাসযোগ্য? ট্যাঙ্কে তো গোলাই ছিল না। ৪৬ বিগ্রেড এর কমান্ডার কর্ণেল শাফায়াত জামিল এর লেখা বই এ আছে- ১৫ আগস্ট দুপুরবেলা সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর নির্দেশে চীফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ এর লিখিত আদেশ অনুযায়ী জয়দেবপুর থেকে ট্যাঙ্কের গোলা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত কিন্তু ট্যাঙ্কে গোলা ছিল না। ১৪ আগস্ট রাতে ট্যাঙ্ক বের করা হয়েছিল, মাসে দুইবার এই রকম নাইট এক্সাসাইজের জন্য ট্যাঙ্ক বের করা হতো, সে সময় ট্যাঙ্কে গোলা থাকে না। নাইট এক্সাসাইজের সময় যে ট্যাঙ্কে গোলা থাকে না, এটা তো কমান্ডারদের না জানার কথা না। ট্যাঙ্কে যে গোলা নাই এটা আই এম শিউর সফিউল্লাহ জানতেন, খালেদ মোশাররফ জানতেন, শাফায়াত জামিলসহ সবাই জানতেন। তারপরে দেখেন, আশ্চর্যের বিষয়- সেদিন রক্ষীবাহিনীর প্রধান ক্যাপ্টেন এ এন এম নুরুজ্জামান দেশের বাইরে, তার ডেপুটি কর্ণেল সাবিউদ্দিন- তিনি ঢাকায় নাই, ঢাকার ভারতীয় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার দিল্লিতে, সোভিয়েত অ্যাম্বাসেডর মস্কোতে- এমন একটা দিনকে তারা বেছে নিলো ঘটনাটি ঘটাতে এবং কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই পরিকল্পনায় সফল করে তারা ফিরে গেলো। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে অনেক কথা শুনি তো; কিন্তু বাস্তবতা হলো বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্য কোনো বীর উত্তম, বীর বিক্রমরা সেদিন এগিয়ে আসেননি, এগিয়ে এসেছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত একজন কর্ণেল- জামিল উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু তিনি আর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি, তার আগেই তাকে হত্যা করা হয়। এইসব বীর উত্তম-বীর বিক্রমরা এখনো জনগণের ট্যাক্সের টাকা খাচ্ছেন।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়…
মহিউদ্দিন আহমদ: এইসব অনেক ব্যাপার আছে যেগুলো তদন্ত সাপেক্ষ। তবে এটা ঠিক- যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছিল, তারই ভিক্টিম হয়েছিল বাংলাদেশ। মুজিব সরকারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এক ধরনের এলার্জি ছিল, ফলে বঙ্গবন্ধুকে সরানো হলে যুক্তরাষ্ট্র যে ওয়েলকাম করবে এটাই তো আমরা ধরে নেবো। তবে ১৫ আগস্টের এই পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল পাকিস্তান। ১৬ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো গণমাধ্যমে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন- সেখানে খুশি হয়ে বাংলাদেশের ভাতৃপ্রতিম জনগণের জন্য পঞ্চাশ হাজার টন চাল, এক কোটি গজ লোন ক্লথ, এবং পঞ্চাশ লাখ গজ সুতি কাপড় উনি উপহার দিবেন বলে অঙ্গীকার করলেন। পাকিস্তান যে রীতিমত খুশি হয়েছিলো তারই প্রমাণ এইটা, এবং ভুট্টোর এই বিবৃতিতে তিনি ইসলামের ঐক্য সংস্থার সমস্ত সদস্য দেশকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তারা যেন বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
বঙ্গবন্ধু জনমানুষের নেতা ছিলেন। সবার কথা তিনি মন দিয়ে শুনতেন; মানুষকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন বলেই হয়তো বিশ্বাস করতে চাননি- কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করবে। সেই সাধারণ মানুষ কেনো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি?
মহিউদ্দিন আহমদ: ৭২-৭৫’ সালের ওই সময়টায় কিন্তু আওয়ামীলীগ সরকারের জনপ্রিয়তায় আস্তে আস্তে ভাটা পড়তে শুরু হয়। এই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ার ঘটনার পুরোটাকে কিন্তু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে না। এখানে আওয়ামীলীগেরও অনেক দায় আছে। আওয়ামীলীগের প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে অভ্যন্তরীণ কোন্দলগুলো শুরু হয়, যার উপর ভিত্তি করেই কিন্তু দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রগুলো হতে পেরেছিল। সুতরাং আওয়ামীলীগকে পুরোপুরি এখানে দায়মুক্তি দেওয়া যাবে না। আজকের দিনের সাথে যদি আমি তুলনা করি তাহলে দেখবেন- এই যে বগুড়ার তুফান সরকারের ঘটনা; তুফান সরকার কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে ম্যাটার করে না, তবুও তার যে অপরাধ- সেই দায় কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উপরই বর্তায়। গালিটা মানুষ তুফান সরকারের বদলে শেখ হাসিনাকেই বেশি দিচ্ছে। ওই সময়ও বিভিন্ন জায়গায় এই রকম শত শত হাজার হাজার তুফান সরকাররা ছিল এবং তাদের সবার দায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর উপরে পড়েছে। একটা ঘটনা আপনাকে বলি- ১৫ আগস্টের ঘটনায় সারা দেশ যেখানে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, অনেকেই আত্মগোপনে গিয়েছিলেন, অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন, অনেকে আবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু রাস্তায় বের হোন নাই কেউ। অথচ বরিশাল শহরে সেদিন আনন্দ মিছিল হয়েছিল, কয়েক হাজার লোক সেখানে অংশ নিয়েছে। রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক আনোয়ারুল আলম এর বই ‘রক্ষীবাহিনীর সত্যমিথ্যা’তে তিনি বরিশালের ওই আনন্দ মিছিলের কারণটি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন- বরিশালের নির্যাতনকারী আওয়ামীলীগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার খুশিতে তারা আনন্দ মিছিল করেছিল, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার কারণে করে নাই। তার মানে আওয়ামীলীগের লোকরা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছিল সারা দেশব্যাপী, যার জন্য মানুষ তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।
প্রিয়.কম: তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে বঙ্গবন্ধুর দূরত্বই কী খন্দকার মোশতাকের মতো বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের সুযোগ করে দিয়েছে?
মহিউদ্দিন আহমদ: বঙ্গবন্ধু নিজেও কিছু ভুল করেছেন, সেই ভুলের মাশুল তিনি যেমন দিয়েছেন, আমরা পুরো জাতি-ই দিচ্ছি। এই ভুল দুটির কথা এখন বলা দরকার। ভুলের উর্ধ্বে তো কেউ না, তিনি বঙ্গবন্ধু- আমাদের সবচেয়ে বড় নেতা, স্বাধীনতার স্থপতি তবুও তিনি ভুলগুলো করেছিলেন। আওয়ামীলীগের ভেতর উপদলীয় কোন্দল ছিল; তাজউদ্দীন আহমেদকে মনে করা হতো তিনি কমিউনিস্ট পার্টির লোক ছিলেন। বাস্তবিকই তিনি তাই ছিলেন, আওয়ামীলীগের মধ্যে তিনি কাজ করতেন। এটা বঙ্গবন্ধুর না জানার কথা না। দলের মধ্যে একদল লোক রেডিক্যাল, আরেক দল মোর কনজারভেটিভ হওয়াটা স্বাভাবিক। এটা বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে ব্যালেন্স করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অনুপস্থিতিতে এই ভারসম্যটা নষ্ট হয়। তখন কোন্দলটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে বেড়ে যায়। সে সময় তাজউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে অন্যান্য এমপিরা কয়েকবার অনাস্থায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ভারত সরকারের কড়া নজরদারি থাকার কারণে বিষয়টা বেশি বাড়তে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধু যখন ফিরলেন তখন যে কোনো কারণেই হোক বঙ্গবন্ধু তার অবস্থান স্পষ্ট করলেন- তিনি তাজউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। কে কীভাবে তাকে কান পড়া দিয়েছে নাকি এটা তার সচেতনভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত, এটাকে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমেদের বিচ্ছেদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় ধরনের ট্রাজিডি। আরেকটি ট্রাজেডি হলো- ওই সময় ছাত্রলীগ দুই ভাগে ভাগ হলো। বিদ্রোহী গ্রুপটি কয়েক মাস পর গিয়ে জাসদ তৈরি করলো। এরা কিন্তু সবাই মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই শক্তি ৭২’ সালের মাঝামাঝি সময় এসে বিভক্ত হলো, এই বিভক্তিটা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। যারা ভাগ হয়ে চলে গেলেন, তারাও কোনো কিছু অর্জন করতে পারলেন না, আর বঙ্গবন্ধুও দুর্বল হয়ে পড়লেন। দুই পক্ষের কেউ-ই লাভবান হোননি। এবং এই যে বিভক্তিটা, এটা কি এড়ানো যেত না? বঙ্গবন্ধু একটি গ্রুপকে বাদ দিয়ে অন্য গ্রুপে আস্থা রাখলেন, এটা তো তিনি তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে ব্যালেন্স করতে পারতেন।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা নিয়ে অনেক কথা শোনা হয়, আপনি একে কিভাবে বিশ্লেষণ করেছেন?
মহিউদ্দিন আহমদ: মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আমি এইভাবে দেখবো না যেভাবে আওয়ামীলীগ বিচার করে। আওয়ামীলীগের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যেহেতু জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপি, এবং তার নেত্রী এখন জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া- যিনি আবার তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ফলে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে তারা বলবে। আমি জিয়াউর রহমানকে একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখি। উনি ছিলেন তখন সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র পার্সন, তাকে ডিঙিয়ে যখন সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হয় এটা সেনা কর্মকর্তারা ভালো চোখে দেখেন নাই। সিনিয়রিটি অনুযায়ী ওই পদটি জিয়াউর রহমানের প্রাপ্য। কিন্তু জেনারেল ওসমানীর পরামর্শে বঙ্গবন্ধু সফিউল্লাহকে পদটি দেন। আবার সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করে, জিয়াকেও তিনি রেখে দিলেন সেনাবাহিনীতে। নিয়ম অনুযায়ী জিয়াকে অবসরে পাঠানো উচিৎ ছিল, সেটা করা হয়নি। ফলে জিয়াউর রহমানের ক্ষোভ থাকাটাও স্বাভাবিক। এই ধরনের ইমম্যাচিউর কিছু কিছু সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এখনো কেউ কেউ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে আছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে এত বিলম্বের কারণ কি বলে মনে করেন?
মহিউদ্দিন আহমদ: এটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। কতিপয় জুনিয়ার সেনা কর্মকর্তা শুধু এর পেছনে জড়িত, তাদের ফাঁসিতে ঝোলালেই যে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পূর্ণ হয়ে যাবে, এই ভাবনা ভুল। এর পেছনে অনেক বড় অপশক্তি আছে। এই ষড়যন্ত্রের মূলে আরো বড় বড় দেশ-বিদেশের মাথা আছে, তাদেরকে শনাক্ত করা প্রয়োজন ছিল। এই ঘটনা কেনো ঘটলো, কারা ঘটালো, কি পারপাসে ঘটালো- এ সকল বিষয়ের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি। যাদের বিচার করা হয়েছে, শাস্তি হয়েছে বা পালিয়ে আছে তাদেরকে তো আমরা সবাই চিনি, কিন্তু যাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই এমন অনেক অপশক্তি এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি কারা ছিল, সেটা খোঁজাটা জরুরি ছিল।
আপনার মতামত লিখুন :