বিলকিস নাহার স্মৃতি, কানাডা থেকে, যখন উপরোক্ত জটিল বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি বাংলাদেশে তখন চলছে ডেঙ্গুর মহামারী(জনমতে)। আর খোদ আমেরিকাতে মর্মান্তিক গানশুটিং নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। এই দুটি ঘটনার একজায়গায় ভীষণ মিল রয়েছে আর তা হলোÑ শুটিং উত্তর দেশটির কর্ণধার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য এবং বাংলাদেশে রক্ষাকর্তাদের মশানিধন কর্মসূচী। ট্রাম্প তার অযৌক্তিক আবেগহীন একতরফা বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন আর আমাদেও কর্নধরেরা নানান হাস্যকর কর্মসূচী পালন কওে ব্যাপক হাস্যরসের খোরাক যোগাচ্ছেন। তামাশাই বটে। জনগনকে আহাম্মক ভেবে লোকদেখানো এসব কর্মসুচী কোনাক্রমেই মানসিক সুস্থতার লক্ষণ নয়। এই দুই ক্ষেত্রেই মূল সমস্যা হলো সাধারণ মানুষের মৃত্যু এবং যন্ত্রনাদাযক অভিজ্ঞতাকে গ্রাহ্যে না নিয়ে, তার বিন্দুমাত্র অনুভব না করে শুধুমাত্র নিজেদের মুখ বা ক্ষমতা রক্ষার যাচ্ছেতাই আস্ফালন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ডিফেন্সিভ বিহেভিয়ার। আর এর উতস স্থলও হলো মানবিক অনুভ’তিগলোর সুস্থ বিকাশ ও প্রকাশের অনুপস্থিতি, ভগ্ন পারিবারিক আবেগীয় নিরাপত্তাবলয় এবং নিরাপত্তাহীনতা- হীনমন্যতা যার মূল সন্ধানে আজকের উপরোক্ত বিষয়গুলোর অবতারনা। অল্প কথায় এসব বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা কঠিন। তারপরও ছোট ছোট করে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করাই এই লিখার মূল উদ্দেশ্য।
লেখাটিতে অনেকগুলো বিষয় একসাথ করা হয়েছে কারণ এই সবগুলো বিষয় ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পর্যায়ে আমাদের আচরণের উতস স্থল। সাম্প্রতিক গবেষনাগুলো বলছে উপনিবেশিক সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ পূর্ববর্তি জেনারশনের মনোজগতে যে নিষ্পেষনের অভিজ্ঞতা রেখে গেছে সেই অভিজ্ঞতাই বংশ পরম্পরায় চলে আসছে, যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মাল্টিজেনারেশনাল ট্রমা যা কিনা পরবর্তি বংশধরদের সুস্থ মানসিক বিকাশের পথে বড় অন্তরায়। আর আবেগীয় নিরাপত্তা বলয় হচ্ছে শিশুর জন্মের পর তার ঘনিষ্টজনদের সাথে যে নিরাপদ সম্পর্ক গড়ে উঠে, যা শিশুর নিজের আবেগ অনুভ’তি নির্ভয়ে শেয়ার করার ক্ষমতা যোগায়, আর এই প্রাথমিক ধাপইুুু শিশুর পরবর্তি জীবনের আবেগ-আচরণের মূল ভিত্তি। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে উপনিবেশ কীভাবে এখনও বিভন্নভাবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে প্রভাব বিস্তার করছে তা জানা ও বুঝা জরুরী।
বিশ^ব্যাপী উপনিবেশের একই চরিত্র ক্ষেত্রবিশেসে শুধু চেহারা বা মুখোশটা ছিল ভিন্ন। উপনিবেশের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ক্ষমতা বলে বিভিন্ এলাকা দখল করে নিজেদের প্রত্যাশা ও প্রয়োজন অনুযায়ী তা পরিচালনা করা। কারণের পিছনের কারণ ছিল ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে সম্পদ কুক্ষিগত করা । অতএব কোনো কারনেই উপনিবেশের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলনা কোনো জাতির জন্য। আর এই ক্ষমতা ও লুটতরাজ অব্যাহত রাখতে তাদেও আরেকটি হতিয়ার ছিল ধমের্র অতি বব্যহার এবং সংস্কৃতি ধ্বংস করা। থমাস ম্যাককালি, যাকে ভারতীয় উপমহাদেশে পশ্চিমা শিক্ষার জনক বলা হতো, তিনি ভারতের তদানিন্তন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বলেছিলেন যে তারা ভারতের এমন এক প্রজাতি তৈরী করবেন যারা চেহারা এবং রংএ হবে ভারতীয় কিন্ত আচার আচরণে ইংলিশ আর এরাই তাবত সাধারণ মানেেষর সাথে তাদেও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। তার উক্তি থেকে বোঝা যায় যে ব্রিটিশরা যে একালচারেশন শুরু করেছিল তা মূলত ছিল একটি এলিট শ্রেনী তেরী করে তাদেও মাধ্যমে ্ওই অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আলাদা করা এবং হেয় করা যা মূলত ছিল জাতিগতভাবে ভারতীয় উপমহাদেশর মানুষের সেল্ফ এসিটম ধ্বংস করে দেয়া। পন্তিত জহরলাল নেহেরু বলেছেন, দীর্ঘ সময় অপরেরর অধিন থাকলে সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরী হয় যা ক্রমে ক্রমে তার সুস্থ বিবেচনা ও নৈতিকতা বোধকে নষ্ট করে ফেলে, আধুনিক মনোবিজ্ঞানও তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করে।
মনোবিজ্ঞানীদেও মতে যখন টিকে থাকার সংগ্রামটাই মুখ্য হয়ে দাড়ায় তখন মানুষের আবেগ ও নীতিনৈতিকতার মত বিষয়গুলো নাম্ব বা অকার্যকর হতে শুরু করে। একশ বছরের উপনেবেশিক শাসন ও শোষনের যন্ত্রনাদায়ক অভিজ্ঞতা আমাদেও পূর্বপুরুষদের ব্যক্তিগত আবেগ অুনভ’তির প্রকাশের যায়গাগুলোকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে, যদিও এই বাধার কারণেই সমষ্ঠিগতভাবে সম্মিলিত আবেগের পথধরেই এসেছে স্বাধীনতা। কিন্তু প্রায় শত বছরের শোষণ ও নির্যাতন আপাতদৃষ্টিতে শেষ হলেও মানুষের মস্তিষ্কে এর ছাপ থেকে যায় আজীবন। আর নিস্পেসনের এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা যা ঘটনার পরও লম্বা সময় ধরে মানুষের মন ও মস্তিষ্কে ক্রিয়শীল থাকে তার নামই ট্রমা বা ভীতি যা পরবর্তি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের আচার, আচরন ও আবেগকে নিয়য়ন্ত্রন কওে, পাল্টে দেয় আবেগ প্রকাশের স্বাভাবিক পথ।
প্রশ্ন আসতে পারে যে পূর্বরুষের ট্রমা কীভাবে বর্তমান জেনারেশনকে ইমপেক্ট করছে। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে উপনিবেশ, শোষন, যুদ্ধ এর মাল্টিজেনারেশনাল ইপেক্ট নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে ও হচ্ছে। বিষেশ করে কানাডায় ইন্ডিজেনাস বা আদিবাসীদের উপর উপনিবেশীকদেও লম্বা সময় ধরে নানা নির্যাতনের মনোসামাজিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক গবেষণা চলছে; এর মূও উদ্দেশ্য হচ্ছে কেন এখানকার আদীবাসিদের তৃতীয় জেনারশনও এই ট্রমা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না তার কারণ উদঘাটন করা। এখানকার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক যেকোনো ডিগ্রী নিতে হলে এই আদিবাসী সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য- সমস্যা এবং সমাধান বিষয়ে বিস্তারিত পড়তে হয়।
পাঠ্যক্রমে অন্তভ’ক্ত গবেষণা পত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন বিশেষ করে আবাসিক স্কুল নির্যাতনের শিকার এখানকার আদিবাসী মানুষেরা মানসিকভাবে আইসোলেটেড ও নিসংগ। পরিবারের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগহীনতা এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ফলে তাদের সুস্থ আবেগীয় বিকাশ সম্ভব হয়নি। এই অসাংগঠনিক ও অবজ্ঞাপূর্ণ মনোসামাজিক পরিস্থিতির কারণে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরীতে তারা অসার্মথ্য। অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও হীনমন্যতা তাদের সকল অনুভুতিকে আচ্ছন্ন করে আছে। তারা যেমন নিজেদেও অনুভ’তিগুলোকে প্রসেস ও প্রকাশ করতে পারে না তেমনি অন্যের আবেগ অনুভুতি বুঝতেও তারা অপারগ ফলে তাদেও বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবন দ্বন্দ-সংঘাতপূণ, তারা একে অপরের প্রতি এবিউসিভ আর এসবের কারণে তারা তাদেও সন্তাদেও সাথে নিরাপদ সম্পর্ক তৈরী করতে পাওে না, পাওে না ভালো অভিভাক হতে। দ্বন্দ-সংঘাত ও নির্যাতনের মাঝে বেড়ে ওঠা তাদের সন্তানরাও একই মানসিক সমস্যায় আর ভোগে আর এইসব মানসিক যন্ত্রনার উপশম হিসেবে আসছে, ড্রাগ, ক্রাইম, ভায়েলেন্স নির্যাতন-এর সবই একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে সৃষ্ট মানসিক সংকট যা পারিবারিক নিরাপত্তা বলয় ও আবেগীয় বন্ধনকে অসংগঠিত করে তাই পারিবারিক এবং সামাজিক সমস্যার মূল কারণ।
শিশুর সুস্থ বিকাশের মূল শর্ত হচ্ছে অভিভাবক বা প্রথমিক সেবাদানকারী ব্যক্তির সাথে শিশুর নিরাপদ বন্ধন। যদি জীবনের শুরুতে এই নিরাপদ বন্ধনের জায়গাটি আঘাতপ্রাপ্ত হয় তবে শিশুর মনোজগতটি হয়ে পড়ে অনিরাপদ ও অসংঘটিত। আর বংশানুক্রমে চলে আসা ট্রমাটিক অভিজ্ঞতার কারণে অধিকাংশ অবিভাবকের পক্ষে এই প্রাথমিক নিরাপত্তা ও আবেগয়ি বন্ধনের জায়গাটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এসব সমস্যা সারা বিশ্বেই আছে বিভিন্ন অনুপাতে , আছে কানাডাতেও অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন পরিমানে। এখানে আদীবাসিরা মূলত মূল সরকার ও সমাজ কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন কারণ এদেশে সরকার পরিচালনা করছে সেটেলাররা অর্থাত বহিরাগতরা এবং তারই মূল সমাজ। তাই সরকার ও আদিবাসীদেও মাঝে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেবটা ভিন্ন, তবে আধা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকায় ট্রমাটাইজ আদিবাসীরা পরিমিত হলেও সরকারী সাহায্য সহযোগিতার মধ্যেই রয়েছে এবং ল এন্ড অর্ডার সিসুয়েশান শক্ত থাকায় তারা ব্যাপক কোন সমস্যা তৈরী করতে পারছে না । এছাড়াও এদশের সরকার বাজেটের একটা বিশাল অংশ খরচ করে দেশের মানুষের বিশেষ করে এই ট্রমাটাইজট মার্জিনাল জনগনের মানসিক স্বস্থ্যসেবার পিছনে। এখানে এই জনসংখ্যা পরিমিত ও চিহ্নিত। কিন্ত আমাদের দেশে লম্বা সময় সংগ্রামের মাধ্যমে ফিরে পাওয়া স্বাধীনতার পক্ষের গনতান্ত্রিক সরকারের সাথে জনগনের সম্পর্কের সমিকরণটা ভিন্ন এবং সাভাবিকভাবেই প্রত্যাশাও অনেক বেশী। কিন্তু পক্ষান্তরে আমাদের সরকার শতবছরের উপনেবেশিক মানসিকতার কারণে যেমন জনগনের সাথে দুরত্ব ঘুচিয়ে জনমুখী হয়ে উঠতে পারছে না একই কারণে জনগনও সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। এই দ্বান্দিক সম্পর্ককে আরও দ্বন্দ্ব ও সংঘাতপূর্ণ করছে সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি মিথ্যাচার, যত্রতত্র ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পারস্পারিক দোষারোপ।
রাষ্টীয় ও সামাজিক পরিমন্ডলের এই অনিয়ম ও অবিচারের মধ্যে বসবাসকারী সাধারণ মানুষকে সর্বক্ষণই নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগ ও উতকন্ঠার মাঝে থাকতে হয়। আর এই মানসিক সংকটের কারণে সুস্থ পারিবারিক জীবন যাপন করাও দূরহ। অশান্তিপূর্ণ পারস্পারিক সমপর্ক, দ্বন্দপূর্ন পারিবারিক পরিবেশের কারণে সৃষ্ট মানসিক ডিস্ট্রেস নিয়ে কথা বলা বা সাহায্য পাওযারও যথেষ্ট ব্যবস্থা এখনও সহজলভ্য নয় কারন মানসিক সাস্থ্য এবং মানসিক স্বস্থ্যসেবা বিষয়টি এখনও অনগ্রসর সমাজব্যবস্থায় যথেষ্ট গ্রহনযোগ্য ও অপরিচিত নয়; তাছাড়াও রয়েছে সামাজিক ট্যবু এবং স্টিগমা। এই মানসিক ডিস্ট্রেস প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনকে যে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তার ফলেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে দ্বন্দ-সংঘাত, অন্যায়-অবিচার। এর মনো-সামাজিক কারণ ও তার মূল সন্ধান সময় সাপেক্ষ হলেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধির কাজ শুরু করা জরুরী।
আপনার মতামত লিখুন :