ফারজানা কাজী : পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতে দেশপ্রেম ও দেশের গৌরব-গাঁথা নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা লেখা থাকে। তার সাথে থাকে রাজা-রানির সুরক্ষা এবং ঈশ্বরের কৃপাকামনা। এসব কারণে জাতীয় সঙ্গীত দাঁড়িয়ে গাইবার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। আবার কিছু কিছু দেশে গণ্যমান্য কবি-সাহিত্যিকদের দেশ ও গণমানুষের জন্যে আশাবাদী রচনাও জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত মনোনয়নে একটু ভিন্নতা আছে এবং তাতে বাঙালিদের যে একটা বাহবা পাবার স্থান আছে, সেটা সকলে জানেন না। এই সঙ্গীত কাউকে দিয়ে লেখানো হয়নি; যেমন অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ৭২৩টি রচনার মধ্য থেকে বাছাই করা হয়েছিলো।
বাংলাদেশকে এই প্রতিযোগিতায় নামতে হয়নি কিংবা কাউকে অনুরোধ করেও জাতীয় সঙ্গীত লেখাতে হয়নি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আমলে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি দেশের গান “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” বিভিন্ন ঘটনা-পরম্পরায় স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন বাউল গানের সহজ সুরে এবং বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে সেই সুরের প্রভাবে। বাউল গানের ছন্দের প্রকৃতি ও তার চলনও তাঁকে মুগ্ধ করেছিলো। বাউল বস্তুতান্ত্রিক মতবাদ সম্পর্কে তিনি সাধারণের থেকে বেশি অবহিত হলেও, তা তাঁর ব্যক্তিগত মতবাদ বা ধর্মবিশ্বাসকে অতিক্রম করেনি। রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের গুণগ্রাহী ছিলেন এবং তার সমাদর করতেন, তখনকার বঙ্গসমাজে ফকির লালন শাহকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে তাঁর অবদানও কম নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতায় হলেও জীবনের মূল্যবান সময় তিনি কাটিয়েছিলেন বর্তমান বাংলাদেশে। কুষ্টিয়ার বাউল গগন হরকরার একটি গান সে-সময় তাঁর খুব পছন্দ হয়ে যায়। গগন চন্দ্রদাস (আনুমানিক ১৮৪৫ খ্রি:-মৃত্যুকাল অজ্ঞাত)। তিনি গগন হরকরা নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি লালন শাহের একজন ভক্ত ছিলেন।
১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন বাংলা অঞ্চলকে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ (বর্তমানে বাংলাদেশ)-এই দুই ভাগে ভাগ করে দেয়, তখন বাঙালিরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে প্রতিদিন লেখা হতো নতুন নতুন গান ও কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই সময় বেশ কিছু গান রচনা করেন। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মনের ভেতর গেঁথে থাকা ১৮৯০ সালে প্রথম শোনা বাউল গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরের সাথে মিল রেখে রচনা করেন “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “গানের কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো।” অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনের ‘হারামণি’ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হতো। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। কারণ, বাউলের সুর ও বাণী আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।”
যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয সংগ্রাম পরিষদ। ৩ মার্চ ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা থেকে ঘোষিত ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ-অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায় গানটির যন্ত্রাণুষঙ্গ পরিচালনা করেন। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার গানটির প্রথম দশ লাইন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন (মোট চরণসংখ্যা পঁচিশটি) এবং যন্ত্রসঙ্গীতে ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয় প্রথম চারটি লাইন। একই বছর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করা “আমার সোনার বাংলা” গানটির স্বরলিপি বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
চলচ্চিত্রকার শহিদ জহির রায়হান ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর বিখ্যাত ‘জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে এই গানের প্রথম চলচ্চিত্রায়ণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীনতা-প্রত্যাশী আপামর জনগণকে এবং মুক্তিযোদ্ধাকে প্রেরণা দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। ‘আমার সোনার বাংলা’ শুধু একটি গানই নয়, একটি আবেগ। এটি শুধু জাতীয় সংগীতই নয়, একটি দেশ। আমাদের সূর্যসন্তানদের রক্তের ঝরনাধারার বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় সঙ্গীত। ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ বহুবার শুনেছি। বুকে েেভতরে কেমন হু-হু করা একটি অনুভুতি হয়। ব্যথায় ভরে ওঠে বুক। কিন্তু এর সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’র মতো হৃৎপি- লাফিয়ে ওঠে না, বুকের রক্ত ঝিলিক দিয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিশিয়ান প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানের সূচনাটাই কিন্তু হয়েছে রবি ঠাকুরের লাইন থেকে। “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” এমন লাইন রবি ঠাকুরের কাছ থেকেই নেয়া। এক গান থেকে জন্ম নেয়া আরেক গানকে নোবেল হাজার গুণ ওপরে তুলতে গিয়ে জাতীয় সঙ্গীতকেই হাজার গুণ নিচে নামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এটা শুধু অজ্ঞতাই নয়, এটি ধৃষ্টতা। বরং নোবেল এতে নিজেই নীচে নেমে গেছেন কয়েক হাজার গুণ। আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে একটি গোষ্ঠীর যথেষ্ট মাথাব্যথা রয়েছে, এটি নতুন নয়। কারণ গানটি একজন ‘হিন্দু’র লেখা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। একথা অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না। তবু, তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন, কবির যে কোনো জাত থাকে না, সেটা বাংলাদেশের ৯৯% মানুষ জানেন না! তাঁরা মনে করেন, যেহেতু রবীন্দ্রনাথ মুসলমান নন, তাই ৯০% মুসলমানের দেশে তাঁর গান কেন জাতীয় সঙ্গীত হবে? হায় মুর্খ জাতি! হায় রে বিকারগ্রস্তের দেশ! আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে যারা অকারণ বিতর্ক করতে চায়, তারা ‘আমার সোনার বাংলা’র পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো গান কেউ লিখে দেখাক তো! এমন প্রাণ কেড়ে নেয়া সুর তৈরি করুক তো! একটি তথ্য হয়তো অনেকেই জানেন না। স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে বাণীসহ প্রতিদিন বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত জাতীয় সঙ্গীতের সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হতো। কিন্তু জিয়াউর ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে এবং এর কিছুকাল পরে বাংলাদেশ বেতারে জাতীয় সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। জিয়াউর রহমানের পতনের আরো পর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে শুধু জাতীয় সঙ্গীতের যন্ত্রসঙ্গীত বাজানো শুরু হয়। জনপ্রিয়তা : শ্রোতাদের পছন্দ অনুসারে বিবিসি বাংলার তৈরি সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম স্থান দখল করে। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে অংশ নেয়া ২০৫টি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের তুলনামূলক বিচারে দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত দ্বিতীয় হয়। প্রথম হয় উরুগুয়ের জাতীয় সংগীত।