নিউজ ডেস্ক : চেকের মাধ্যমে ঘুষ নেয়ার মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও তার স্ত্রী সিগমা হুদার বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন করেছে দুদক। যুগান্তর
সোমবার কমিশন সভায় দু’জনকে আসামি করে এই চার্জশিট অনুমোদন দেয়া হয়। দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মঙ্গলবার ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতে এ দুই আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হবে বলে জানা গেছে। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম মামলার তদন্ত শেষে দু’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের সুপারিশ করলে তা গৃহীত হয়।
দণ্ডবিধির ১৬১০১৬৫(ক) (ঘুষ নেয়া) ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় (ক্ষমতার অপব্যবহার) দু’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন করে কমিশন।
দুদক সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ১৮ জুন রাজধানীর মতিঝিল থানায় নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, যমুনা সেতুর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডকে নিযুক্ত করা হয়। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। দাবিকৃত টাকা তার স্ত্রীর মালিকানায় পরিচালিত ‘খবরের অন্তরালে’ পত্রিকার হিসাবে জমা দেয়ার জন্য বলেন। মাসিক কিস্তিতে দাবিকৃত টাকা না দেয়া হলে ওই প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি নিয়োগ বাতিল করে কালো তালিকাভুক্ত করার হুমকি দেন নাজমুল হুদা।
অবশেষে নিরুপায় হয়ে ব্যাপক ব্যবসায়িক ক্ষতি বিবেচনা করে মাসে ২৫ হাজার টাকা উৎকোচ প্রদানের প্রস্তাব করলে নাজমুল হুদা দম্পতি তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি বাধ্য হয়ে শুরুতে ৫০ হাজার এবং পরে ২৫ হাজার আবার ৫০ হাজার টাকা করে দেয়।
এরপর তারা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকের কাছ থেকে ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৬ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে চেকের মাধ্যমে ৬ লাখ টাকা ঘুষ নেন। মামলাটির কার্যক্রম ২০১৬ সালে হাইকোর্ট বাতিল করলেও ২০১৭ সালের ৭ মার্চ দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ বাতিল করেন আপিল বিভাগ।
হাইকোর্টের আদেশের পর দুদক আবারও তদন্তে নামে। চলতি বছরের ২৭ ফেব্র“য়ারি নাজমুল হুদাকে দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের সহকারী পরিচালক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম।
ওইদিন ৭ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নাজমুল হুদা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এক-এগারোর সময় জেনারেল মতিনের ইচ্ছায় ওই মামলা হয়েছিল। এটা ঘুষের টাকা নয় বলেও তিনি দাবি করেন। তিনি তখন
সাংবাদিকদের কাছে আরও বলেছিলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার রোষানলে পড়েন তিনি। তবে তদন্তে তার ওই বক্তব্য টেকেনি। তিনি তদন্তকালে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেননি বলে দুদকের কর্মকর্তারা জানান।
তারা বলেন, তদন্তকালে নাজমুল হুদা কোনোভাবেই বলতে পারেননি যে, তিনি ঘুষ নেননি বা ঘুষের বিষয়ে তাদের সঙ্গে কারও কথা হয়নি। যারা ঘুষ দিয়েছেন, তাদেরই একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে নাজমুল হুদাকে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে তদন্তের স্বার্থে ওই ব্যক্তিকে আসামি না করে সাক্ষী করা হয়েছে বলে জানান একজন কর্মকর্তা।
২০০৮ সালে দুদকের দায়ের করা এই মামলায় নাজমুল হুদা জামিনে ছিলেন। ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ হাইকোর্ট মামলাটি কোয়াশ করেন। ফলে মামলার তদন্তকাজ বন্ধ ছিল বলে জানা যায়। পরে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৭ সালের ৭ মার্চ হাইকোর্টের দেয়া কোয়াশ আদেশ স্থগিত করেন। এরপর মামলার তদন্তকাজ চলতে আইনগত বাধা থাকল না। এ পর্যায়ে জামিন ছাড়াই তারা বছর পার করে দেন।
এ নিয়ে যুগান্তরে রিপোর্ট প্রকাশ হলে নাজমুল হুদা যুগান্তর কর্তৃপক্ষের ওপর নাখোশ হন। কিন্তু দুদকের তদন্তে অবশেষে সত্যিই প্রমাণিত হল, নাজমুল হুদা দম্পতি ঘুষের ঘটনায় জড়িত। তদন্তে সেটাই প্রমাণের বিষয় ছিল।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘নেট ওয়ান সলিউশন লিমিটেড’ এবং ইন্দোনেশীয় প্রতিষ্ঠান ‘পিটি জাসা মার্গা (পারসেরো) যৌথভাবে মার্গানেট ওয়ান লিমিটেড নাম দিয়ে জয়েন স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধিত হয়। যার নিবন্ধন নং সি-৫০৭৩২(১০২৭)/২০০৩। মার্গানেট ওয়ান লিমিটেড সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে যমুনা বহুমুখী সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা ও টোল আদায়ের সময় ২০০৪ সালের আগস্টে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা (যিনি যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের বোর্ডসভায় চেয়ারম্যান ছিলেন) মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমেদ ফারুককে টেলিফোনে মার্গানেট ওয়ান লিমিটেড থেকে মাসিক ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করেন।
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বলেন, তার স্ত্রী অ্যাডভোকেট সিগমা হুদার মালিকানাধীন পত্রিকা ‘খবরের অন্তরালে’ পরিচালনার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। উৎকোচের ওই টাকা দিয়ে মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের নামে বিজ্ঞাপন ‘খবরের অন্তরালে’ পত্রিকায় ছাপা হলে এই বিষয়টি কারও সন্দেহ হবে না।
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার দাবিকৃত মাসিক ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ প্রদান করা মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের পক্ষে সম্ভব নয় এবং মার্গানেট ওয়ান লিমিটেড একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিধায় বিজ্ঞাপন প্রচার করার প্রয়োজন নেই, অন্য কোনো পত্রিকায়ও তার এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার করেন না মর্মে জানান। এতে আসামি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা খুবই রাগান্বিত হয়ে পড়েন।
তিনি হুমকি দেন, মাসিক ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ প্রদান না করা হলে মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডকে বাংলাদেশে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এছাড়া যমুনা বহুমুখী সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা ও টোল আদায়ের কার্যাদেশ বাতিল করা হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার হুমকির বিষয়টি মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমেদ ফারুক মার্গানেট ওয়ানের পরিচালকদের জানান এবং পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপন করেন। মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের পরিচালনা পরিষদ তাদের ব্যবসায় যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় এবং প্রতিষ্ঠানের প্রচুর আর্থিক বিনিয়োগের বিষয় বিবেচনা করে আসামি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার চাহিদা অনুযায়ী মাসিক ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ দিতে সম্মত হয়। মাসিক উৎকোচের পরিমাণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমেদ ফারুককে অনুরোধ করেন।
পরিচালনা পর্ষদের আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমেদ ফারুক (বর্তমানে সিএও), পরিচালক আরএ হাওলাদার আনোয়ারুল হক, পরিচালক এসএমএ মান্নান এবং পরিচালক মো. মোবারক হোসেন।
পরিচালকদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমেদ ফারুক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আসামি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার স্ত্রী মিসেস সিগমা হুদার মালিকানাধীন পত্রিকা ‘খবরের অন্তরালে’ (সাপ্তাহিক পত্রিকা) বিজ্ঞাপন বিল বাবদ প্রথম মাসে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে ২৫ হাজার টাকা করে প্রদান করেন। কয়েক মাস পর ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা আবারও রাগান্বিত হয়ে টেলিফোন করলে পুনরায় মাসে উৎকোচ বাবদ ৫০ হাজার টাকা নাজমুল হুদার নির্দেশ অনুযায়ী পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিল বাবদ প্রদান করেন।
এভাবে কয়েক মাস দেয়ার পর পুনরায় মার্গানেট ওয়ান লিমিটেডের আর্থিক বিষয় বিবেচনা করে প্রতিমাসে ২৫ হাজার টাকা করে পরিশোধ করেন। এভাবে মার্গানেট ওয়ান লিমিটেড কর্তৃপক্ষ হুমকির মুখে বাধ্য হয়ে নাজমুল হুদা ও তার স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯টি চেকের মাধ্যমে উৎকোচ বাবদ ৬ লাখ টাকা প্রদান করেন, যা পরবর্তী সময়ে ক্লিয়ারিং হাউসের মাধ্যমে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড মতিঝিল শাখায় খবরের অন্তরালের হিসাবে (চলতি হিসাব নং-১১০৮৫০৯২) জমা হয়।
/এএস
আপনার মতামত লিখুন :