ডেস্ক রিপোর্ট : ব্রিটেনের বিখ্যাত টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক খবরে চলতি বছরে এই ব্যাপক ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের জন্য রাজধানীতে অবকাঠামো নির্মাণের মহাযজ্ঞকে দায়ী করা হয়েছে। যুগান্তর
এতে বলা হয়েছে, মেট্রো রেলসহ বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের কারণে নগরীতে অসংখ্য গর্তে স্থির পানি জমে থাকায় এই সংক্রমণের বিস্তার ঘটেছে।
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গ মহামারির মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক পদক্ষেপ না নেয়া হলে এই মহামারির ঝুঁকি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
টেলিগ্রাফ পত্রিকার খবর বলছে, এখন পর্যন্ত ৪১ জনের বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩টিতেই ছড়িয়ে পড়েছে এই সংক্রামক রোগ। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, রেকর্ড রাখার পর থেকে এবারই প্রথম এটি ভয়াবহ মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু।
জুন থেকে অক্টোবরে বর্ষার মৌসুমে মারাত্মক বিস্তার ঘটে এ সংক্রমণের। এ সময়ে জমে থাকা স্থির পানি ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার প্রজননের সঠিক পরিবেশ তৈরি করে দেয়।
ডেঙ্গুর এই আকস্মিক বিস্তারে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গত জুনে এক হাজার ৮২০টি আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জুলাইয়ের ২৯ ও ৩০ তারিখের মধ্যে নতুন করে এক হাজার ৩৩৫টি রোগীর শরীরে এই সংক্রমণ দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্তের ৮৮ শতাংশ ঘটছে ঢাকাতেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে শুরু করে বড় হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা এতোই বেশি যে নতুন করে রোগী ভর্তি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
যাদের চিকিৎসা খুবই জরুরি, তাদেরকে হাসপাতালের ফ্লোর, করিডর কিংবা বারান্দায় স্থান করে নিতে হচ্ছে।
বিশ্বের বড় বড় মহানগরগুলো এডিস মশার বংশবিস্তারে উপযুক্ত প্রজনন স্থলের ব্যবস্থা করে দেয়। এতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। বিশ্লেষকদের মতে, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা নাটকীয়হারে বাড়ছে।
গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ নামের একটি গবেষণা প্রবন্ধের তথ্যানুসারে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই রোগে ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ মৃত্যু বেড়েছে। অর্থাৎ সাড়ে ২৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪০ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত নিবন্ধটির বরাতে ব্রিটেনের বিখ্যাত টেলিগ্রাফ পত্রিকা বলছে, তবে আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে মৃতের তুলনা অপেক্ষাকৃত বিরলই বটে। ২০১৭ সালে ১০ কোটি ৪৮ লাখ লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
সমীক্ষার লেখকরা বলছেন, সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে ডেঙ্গু অন্যতম, যেটি ক্রমাগত বেড়েই চলছে। এতে আগামী পাঁচ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে পৌঁছাবে।
আরেক নামে ব্রেক-বোন জ্বর বলেও পরিচিত ডেঙ্গু। এতে আক্রান্ত হলে শরীরের সংযোগস্থলগুলোতে প্রচণ্ড ব্যথার দরুন রোগটিকে ডাকা হয় এ নামে।
এছাড়া মাথা ও মাংসপেশিতে ব্যথা, লালাগন্থি ফুলে যাওয়া, ছোট ছোট ফুসকুড়ি ওঠে এবং অবসন্নতা দেখা দেয়। এডিস এজিপটি মশার মাধ্যমে এটির সংক্রমণ ঘটে।
বিশ্বের চল্লিশ শতাংশ মানুষ এমন জায়গায় বসবাস করেন, যেখানে এই রোগের ঝুঁকি রয়েছে। খুবই ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকায় এই সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঘটে।
বিশেষকরে যেখানে ছোট ছোট গর্ত কিংবা ডোবায় স্থির পানি জমে থাকে। এগুলো মশা প্রজননের জন্য খুবই উপযুক্ত জায়গা।
গবেষণাটির অন্যতম লেখক ও ওয়াশিংট্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ববি রায়নার বলেন, গ্রামীণ থেকে শহুরে জীবন যাপনের ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিবর্তনের কারণেই রোগটি সংক্রমণ এতো বেড়েছে। অপরিকল্পিত মহানগরীতে যারা খুবই দরিদ্র অবস্থায় থাকেন, বিশেষকরে তাদের ঝুঁকি বেশি।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু হচ্ছে শহুরে মশাবাহিত একটি রোগ। শহরের দরিদ্র এলাকাগুলোতে জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। যেখানে জানালায় কোনো পর্দা থাকে না, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র নেই এবং যে এলাকায় প্রচুর স্থির পানি থাকে। ডেঙ্গু বিস্তারে এটা খুবই আদর্শ পরিবেশ।
ডা. রেইনের মতে, এসব দরিদ্র এলাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণের মোকাবেলায় তেমন কোনো উদ্যোগ থাকে না। এ রোগটির একমাত্র টিকা এখনো অসম্পূর্ণ। এমনকি এডিস নিয়ন্ত্রণে কীটনাশকসহ অন্যান্য পদক্ষেপের ওপর তেমন কোনো গবেষণাও নেই।
কাজেই এই দুর্যোগ মোকাবেলায় কী করতে হবে, সে নিয়েও চেষ্টার অভাব রয়েছে বলে জানান এই গবেষক।
ডেঙ্গুর চারটি ভিন্ন সিরোটাইপ কিংবা প্রজাতি রয়েছে। একটি সিরোটাইপে কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর তার শরীরে যদি ফের আরেকটির সংক্রমণ ঘটে, তখনই রোগটি মারাত্মক রূপ নেয়ার আশঙ্কা বেশি।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাচেল লোও বলেন, বিশ্বজুড়ে লোকজনকে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতে হয়। এতে ভিন্ন ধরনের সিরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
এ গবেষণায় ডা. রাচেল লোও জড়িত। তিনি বলেন, ভিন্ন সিরোটাইপে বারবার সংক্রমণে ডেঙ্গু মারাত্মক রূপ নিতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
‘যখন আপনি একটি ক্রমবর্ধমান শহর এলাকায় বসবাস করবেন, যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা একেবারেই দুর্বল, ডেঙ্গুর বাহক ও মানুষের বসবাস খুবই ঘনিষ্ঠ, সেখানে এই সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।’
এই গবেষক বলেন, ডেঙ্গুবাহী মশা দিনের বেলায় মানুষকে কামড়ায়। কাজেই ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে রাতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা এখানে ব্যর্থ।
ডা. লওয়া বলেন, এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ চরম ও কঠিন একটি কাজ। যখন কোন একটি জায়গাজুড়ে এই জীবাণুবাহী মশা নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে বসে, তখন তার থেকে মুক্ত হওয়া বেশ কঠিনই বটে।
এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং মানুষ যাতে অস্থায়ী সংরক্ষিত পানিতে নির্ভরশীল হতে না হয়, সেই নিশ্চয়তা বিধানও রাখতে বললেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :