কুলদা রায় : নোবেলের বাবা মোজাফফর হোসেন নান্নু আমার সহপাঠী। একই স্কুলে পড়েছি। নান্নু খুবই শান্তশিষ্ট অমায়িক মানুষ। খুব সুন্দর গানের গলা ছিলো। হারমোনিয়াম বাজাতে পারতো না। কিন্তু গাইতো মিষ্টি করে। এখনো আমার কানে লেগে আছে ছেলেবেলায় নান্নুর গলায় শোনা গান... আমারে সাজাইয়া দিও নওশারও সাজে। স্কুলের অনুষ্ঠানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন কণ্ঠশিল্পী আব্দুল আলীম। এই গানটি শুনে নান্নুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করেছিলেন আব্দুল আলীম। আমাদের স্কুলে তখন গান গাইতেন সাইফুল্লাহ খালিদ ভাই। তিনি গাইতেন আধুনিক আর শচীন কর্তার গান। সাজ্জাদ আলী বাদল গাইতেন রবীন্দ্র সংগীত। হাইস্কুলে সুবাস দাস দুলু এসে ভর্তি হয় আমার ক্লাসে। দুলু গাইতো মান্নাদে আর হেমন্তের গান। নান্নুকে স্কুলের সবাই পছন্দ করতো। আমি মধুমতি নদী সাঁতরে ঘোষের চরে ওদের বাড়িতেও গেছি দুপুর বেলা। নান্নুর আরেক চাচাতো ভাই হাবীব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নান্নুর ছোট ভাই আমাদের শহরে সৎ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত।
ওরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মোজাফফরের চাচা শহীদ আব্দুল লতিফ গোপালগঞ্জের কিংবদন্তি তুল্য মুক্তিযোদ্ধা। তার নামে তাদের ইউনিয়নের নাম লতিফপুর। নান্নুর ছেলে নোবেল সারেগামাপা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে দুই দেশে। নোবেল জেমসের একটি দেশাত্মবোধক গান গেয়েছিলো অনুষ্ঠানে। এক সাক্ষাৎকারে ও বলেছে, প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি দেশকে খুব ভালোভাবে এক্সপ্লেইন করেছে। আমাদের জাতীয় সংগীতে সমসাময়িক ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ নেই। কিন্তু প্রিন্স মাহমুদের লেখা গানটিতে ভাষাণী, বঙ্গবন্ধু, বিএনপির জিয়া, কবি জসীম উদ্দীন প্রমুখের কথা আছে। এজন্য রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলার চেয়ে প্রিন্স মাহমুদের আমার সোনার বাংলা গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে বেশি উপযুক্ত।
রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলার সঙ্গে প্রিন্স মাহমুদের গানের কোনো তুলনা আনাই যায় না। প্রিন্স মাহমুদের গানের ভাব ও ভাষা শিথিল। সামগ্রিকতা নেই। সংখ্যালঘু কোনো মানুষের উল্লেখ নেই। গানটি ভাব ভাষাতে কোনো অর্থেই সাবলাইম নয়। সুরের মধ্যেও বাংলা গানের ঐতিহ্যকে পুরোপুরি অনুসরণ করে না। আদর্শের দিক দিয়ে চিন্তা করলে এই গানে প্রতিক্রিয়াশীলদেরও সমাবেশ আছে। এর চেয়ে আমাদের দেশে অনেক ভালো দেশাত্মবোধক গান রয়েছে। তাহলে এই ধরনের অতি সাধারণ মানের ভুল বাক্যের গানকে রবীন্দ্রনাথের চিরায়ত গানের বদলি হিসেবে দাবি করা দূরে থাকুক, চিন্তা করাটাই নি¤œরুচির ব্যাপার। দেশে জাতীয় সংগীত বদলের দাবি তোলা হয় মাঝে মাঝে। কারা তোলে? জামায়াতে ইসলামীসহ উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো। এদের নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোতে রবীন্দ্রনাথের লেখা আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি জাতীয় সংগীতটি গাওয়া হয় না। ওয়াজ মাহফিলে গানটি ও গানটির রচয়িতাকে নিয়ে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করা হয়। বলা হয় হিন্দুর রচিত জাতীয় সংগীতটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ঈমান আকিদার সঙ্গে খাপ খায় না। এটা বদলাতে হবে। হেফাজতে ইসলামীর তাত্ত্বিক জঙ্গিবাদী ফরহাদ মজহার রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ বই লিখে ভুলভাল কথা বলে রবীন্দ্রবিদ্বেষকে উসকে দিয়েছেন। সেখানে বলেছেন, মোঘলরা ‘বাঙালা’ লিখতো। তারা মুসলমান ছিলো বলে হিন্দু রবীন্দ্রনাথ শব্দটিকে বাঙালার বদলে বাংলা করে মুসলমানত্বকে ছেঁটে ফেলেছেন। তার মতে, একজন মুসলমান জাতীয় সংগীতটি লিখলে শোভন হতো। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করতে চেষ্টা হয়েছিলো। বাংলাদেশ আমলে জামায়াতে ইসলামীসহ মৌলবাদীরা রবীন্দ্রনাথ রচিত জাতীয় সংগীতটি বদলের দাবি করে পাকিস্তানপন্থী সাম্প্রদায়িক আদর্শ থেকে। সেটা ভয়ংকর। কিন্তু নোবল বা তার পরিবারের কেউই পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি বা আদর্শকে ধারণ করে না। তার বয়স মাত্র একুশ। ঘোষের চর গ্রামে সে বেড়ে উঠেছে। গোপালগঞ্জের মতো একটি মফস্বল শহরে পড়েছে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঠিক শিক্ষা দীক্ষা দেয়ার চল নেই। বইপত্রে চলছে সাম্প্রদায়িকীকরণ। হিন্দু সাহিত্যিকদের লেখাপত্র বাতিল করা হচ্ছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে সরকারও কার্যত সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের স্বার্থরক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে দেশে উদার, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানবাদী, যুক্তিবাদী, মানবিক, ধ্যান-ধারণা, নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে। এ কারণে আমাদের নতুন প্রজন্ম ভুল পাঠ নিয়ে বেড়ে উঠছে। তাদের প্রকৃত সাহিত্যবোধই নেই। তারা ঘৃণার মধ্যে জন্ম নিয়ে ঘৃণাবাদী হয়ে উঠছে প্রচ্ছন্নভাবে। তারা সুন্দরভাবে কথা বলতেও শেখেনি। যা বলে তা ভুল বলে, অর্ধসত্য বলে অথবা অসত্য বলে। এটা তাদের দোষ নয়। তাদের এভাবেই গড়ে তোলা হচ্ছে।
আমার বন্ধু নান্নুর ছেলে নোবেল এ রকম পরিবেশেই বেড়ে উঠেছে। রবীন্দ্র সংগীতের ভাবসম্পদ বোঝার মতো ক্ষমতাই তার নেই। না বুঝেই গান করে। আমার মনে হয়, নোবেল কোনো কিছু না ভেবেই ভুলকথা বলে ফেলেছে। অল্প বয়স হেতু এ রকম কথা অনেকেই বলে ফেলে। এর দায় তার নয়। দায় রাষ্ট্র ও ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক শক্তির। তারা যখন রবীন্দ্র সংগীত বদলের কথা বলে তখন তারা পরিকল্পিত একটা ষড়যন্ত্র থেকেই বলে। সেটা ভয়ের। সেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। নোবেলের জাতীয় সংগীত বিষয়ক কথাকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। ছেলেটি গান গেয়ে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। এখন তাকে প্রকৃত গান শেখার জন্য কোনো ওস্তাদের কাছে গভীরভাবে তালিম নিতে হবে। শুধু গানের কথা নয়, তার ভাব সম্পদকেও আত্মস্থ করতে হবে। তাহলে আরও অনেকদূর যেতে পারবে। ধীরে ধীরে কথা বলাও শিখবে। মৌলবাদের কথাবার্তাকে অবচেতনভাবেও বাদ দিতে সক্ষম হবে। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :