আহমেদ শাহেদ : সাগর পারের ছোট্ট জেলা শহর বরগুনায় কুপিয়ে হত্যা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাস ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এর সঙ্গে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার কুরে কুরে খাচ্ছিল অনগ্রসর এই জেলাকে। এসবের সঙ্গে দখলবাজি, বিশেষ করে তালতলীতে রাখাইন সম্প্রদায়ের জমি জোর করে লিখিয়ে নিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার বহু ঘটনাও ঘটেছে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, এসব অপকর্মের সঙ্গে ঘুরেফিরে এসেছে বরগুনা সদর আসনের এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথের পুত্র সুনাম দেবনাথের নাম। যুগান্তর
সন্ত্রাস-ছিনতাই-খুন কিংবা মাদক বাণিজ্য, যখন যে ঘটনাই ঘটেছে আলোচনান্তে উঠে এসেছে এই ‘যুবরাজ’এর নাম। এর পর যা হওয়ার তাই- রহস্যজনক কারণে থেমে যেত সব।
পুলিশি তদন্ত কিংবা আসামি গ্রেফতার সব কিছুতেই খেই হারিয়ে যেত। তবে চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার আগে মানুষ ভেবেছিল এই ঘটনাও হয়তো হারিয়ে যাবে। ভিডিওটি ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশের পর এই ঘটনা আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। শুধু তাই নয়, একের পর এক বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে নিভৃত এই জেলা শহরের আলোর বিপরীতে থাকা অন্ধকার দিকগুলো।
চাপা পড়ে গেছে যুবলীগ কর্মী বাদশা হত্যাকাণ্ড : ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুবলীগ কর্মী শামীম ইমতিয়াজ বাদশাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হতা করা হয়। ৩ বছরের কন্যাসন্তানের পিতা বাদশা নিজেও ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান।
ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তখন বহু মিছিল সমাবেশ বিক্ষোভ হয়েছে। পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামি রাকিব সরদারকে গ্রেফতারও করেছিল।
কিন্তু রাকিব পরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘৬ নং বুড়ির চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমানের পরিকল্পনা ও নির্দেশে আমি বাদশাকে হত্যা করেছি।’
তার পরই সব থমকে যায়। এক পর্যায়ে রহস্যজনক কারণে মামলা তদন্তের ভার দেয়া হয় সিআইডিতে। চাপা পড়ে যায় বাদশা হত্যা মামলা। এই সিদ্দিকুর রহমান হচ্ছেন বরগুনা সদরের এমপি টানা ২৭ বছর ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর আপন ভায়রা।
আর এই ভায়রার সুবাদে শম্ভু বহু বছর ধরে বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। বরগুনা জেলা যুবলীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ বলেন, ‘যখনই কোনো অপরাধের পেছনে বড় কেউ থাকে ঠিক তখনই চাপা পড়ে যায় বড় বড় অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনীও হয়ে পড়ে অসহায়।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ধরেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
কামরাবাদের অনেকেই যুগান্তরকে বলেছেন, ‘এমপি শম্ভু’র অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের রাজনীতি করতেন নিহত বাদশা। পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এলাকায় সুনামও ছিল তার। কামরাবাদ বাজারে যারা বাদশাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন, তারা সবাই বলবে ঘাতকরা সবাই ছিল সুনাম দেবনাথের অনুসারী। বাদশার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চোখের জল ছাড়া আর অবশিষ্ট নেই কিছুই।
সব অপকর্মের নেপথ্যে সুনাম? বরগুনায় প্রধান দুটি গ্রুপে বিভক্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এর একটি নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি শম্ভু এবং অপরটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেনসহ অন্যরা।
বরগুনা জেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, এমপি শম্ভুর সঙ্গে যারা আছে তারা প্রায় সবাই-ই তার আত্মীয়। তাদের প্রায় সবাই দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে।
তবে জনসমর্থন এবং যাদের অবস্থান ভালো তাদের প্রায় কেউ নেই শম্ভুর সঙ্গে। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে এরাই একাট্টা হয়েছিলেন শম্ভুর মনোনয়নের বিরুদ্ধে। এর আগে সন্ত্রাস এবং মাদক বাণিজ্যের অভিযোগ শম্ভুকে বরগুনায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।
পরে দু’পক্ষকে ঢাকায় ডেকে মীমাংসার উদ্যোগ পর্যন্ত নিতে হয় কেন্দ্রকে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সমর্থন শূন্যের কোঠায় চলে যাওয়ার পর নিজের চারপাশ আবার ভারি করার চেষ্টায় নামেন শম্ভু। তাকে সহায়তা করছিলেন ছেলে সুনাম দেবনাথ।
তবে আগে থেকেই ছিল সন্ত্রাসীদের তোষণ করা ছাড়াও সুনামের বিরুদ্ধে মাদক বাণিজ্যের বিস্তর অভিযোগ। স্বভাবতই সুনামের চারপাশে ঠাঁই হয় নয়ন বন্ডসহ মাদক ও সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্তরা। তাছাড়া অপরাধ করেও পার পাওয়ায় আশায়ও অনেকে ভেড়েন সুমানের সাম্রাজ্যে।
রিফাত শরীফ হত্যার মূল নায়ক, ক্রসফায়ারে নিহত নয়ন বন্ডের এক বন্ধু বলেন, ‘২০১১ সাল থেকেই মূলত পুলিশের খাতায় প্রথম নাম ওঠে নয়নের। ২০১৫ সালে এসে সে পরিণত হয় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে। তার বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা-গ্রেফতারসহ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে নালিশের পাল্লা ভারি হতে থাকলে, নয়ন রাজনৈতিক ছত্রছায়া খুঁজতে থাকে।
পরে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরাদ হোসাইনের হাত ধরে তার অভিষেক ঘটে জেলা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। এই মুরাদই তাকে পৌঁছে দেয় সুনাম দেবনাথের কাছে। সেখানে তার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয় সুনাম চাচাতো শ্যালক শাওন তালুকদার ও অভিজিৎ তালুকদারের সঙ্গে।
পরে তারা দু’জনই হয়ে ওঠে নয়নের বস। তবে নয়ন বন্ডের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল সুনামের।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বরগুনা পৌরসভার একজন কাউন্সিলর বলেন, ‘একবার একটি করাত কলে চাঁদাবাজি করতে যায় নয়ন। খবর পেয়ে পুলিশকে জানিয়ে আমিও সেখানে যাই। পুলিশ যখন নয়নকে গ্রেফতার করে থানায় নিচ্ছিল তখন সে সুনামকে ফোন দেয়। এরইমধ্যে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে চলে যায় পুলিশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আর থানা পর্যন্ত যেতে হয়নি। মাঝপথেই তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।’
সুনামের ডান হাত হিসেবে পরিচিত শাওন তালুকদার ও অভিজিৎ এবং নিহত নয়ন বন্ডের বহু সন্ত্রাসী ঘটনা এখন বরগুনার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
২০১৬ সালে বরগুনা থানায় একটি মামলার সূত্রে জানা যায়, নয়ন ও অভিজিতের বাহিনী শহরের এক কাপড় ব্যবসায়ী শাহিনের দোকানে ঢুকে হামলা ভাংচুর এবং লুটপাট চালায়। শাহিনের বাসায়ও হামলা চালিয়ে লুটে নেয় স্বর্ণালঙ্কার। যুগান্তরকে শাহিন বলেন, ‘মামলা হলেও খুব একটা লাভ হয়নি। বরং এদের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়েছে আমাদের।’
পাথরঘাটা শহরের বাসিন্দা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘২০১৭ সালে আমার মোটরসাইকেলসহ এক বন্ধুকে অপহরণ করে নিয়ে যায় অভিজিৎ নয়নসহ তাদের বাহিনী। বরগুনা শহরের কিছু লোকের পরামর্শে সুনামের বাড়িতে গিয়ে তাকে (সুনাম) সবকিছু জানাই। পরদিন সকালে মোটরসাইকেল ফেরত পাই।
সেসময় সুনামের বাসার নিচতলায় নয়ন এবং অভিজিৎ ও তাদের বাহিনীর অনেককে একসঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা যায়। বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক বলেন, ‘শাওন এবং অভিজিৎ এমপিপুত্র সুনামের ডান হাত। এদের দিয়েই সন্ত্রাস-মাদক বাণিজ্য চালায় সুনাম। বরগুনা শহরের যত সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তার নেপথ্যেও এরা। সুনামের হয়ে এরাই বরগুনায় সন্ত্রাসীদের লালন করে।’
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শাওন তালুকদার বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। কিন্তু কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার কোনো সখ্য ছিল না।’
প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব : সুনাম- সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়া এবং মাদক বাণিজ্যের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এমপি শম্ভুপুত্র সুনাম দেবনাথ।
তিনি বলেন, ‘মূলত রাজনৈতিক শত্রুতা উদ্ধারের জন্যই এসব কাহিনী ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে মিন্নিকে গ্রেফতারের পেছনে নাকি আমার হাত রয়েছে। যারা এটা বলছে তারা এটাও বলুক যে মিন্নি গ্রেফতার হওয়ায় আমার কি লাভ হয়েছে?
মিন্নি গ্রেফতার হয়েছে বলে কি কোনো আসামি ছাড়া পাবে? কেউ কি হত্যার দায় থেকে মুক্ত হবে? নয়ন বন্ড এরই মধ্যে নিহত হয়েছে। রিফাত-রিশানসহ মূল আসামিরা জেলে। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে সবাই। তাহলে এখানে মিন্নি গ্রেফতার হওয়া বা না হওয়ায় আমার কি আসে-যায়?’
মিন্নির বাবা একবার বলছেন আমার বাবা এমপি শম্ভু মিন্নিকে গ্রেফতার করিয়েছে, আবার বলছেন দেলোয়ার সাহেবের স্ত্রীর নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
আসলে উনি কী বলতে চাইছেন? সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়া প্রসঙ্গে সুনাম বলেন, ‘শাওন কিংবা অভিজিৎ কেউই আমার শ্যালক নন। তাছাড়া অভিজিতের সঙ্গে এখন আর আমার কোনো যোগাযোগও নেই। শাওনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা তো দূরের কথা, একটা জিডিও নেই কোনো থানায়।
কে জিয়াউর রহমান, তাকে তো আমি চিনিও না। তার মোটরসাইকেল আমি কবে উদ্ধার করে দিলাম? আমার বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে তা সর্বৈব মিথ্যা। নিহত বাদশা আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তার হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার হোক। তাতে যেই আসামি হবে আমি তার বিচার চাই। আমার বাবা ৫ বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।
জনপ্রিয়তার প্রশ্নে তার কাছাকাছিও বরগুনায় কেউ নেই। যে কারণে রাজনৈতিকভাবে আমাদের ধ্বংস করার জন্য এসব মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। একটি মহল একজোট হয়ে এসব করছে। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে এরা সবাই জোট বেঁধে আমার বাবার মনোনয়নের বিরোধিতা করেছে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো কিছুই অজানা নয়। তাই তো তিনি আমার বাবাকেই আবার মনোনয়ন দিয়েছেন। কোন সন্ত্রাসীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে তার সুর্নিদিষ্ট প্রমাণ না দিয়ে ভাসা ভাসা বললে তো হবে না। কেবল নয়ন বন্ডই নয়, কোন সন্ত্রাসীর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে কিংবা কোন সন্ত্রাসীর জন্য আমি পুলিশ কিংবা কোথাও কোন তদবির করেছি তার প্রমাণ দিতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।
সাংবাদিক ভাইদের কাছে আমার অনুরোধ যা লিখবেন বা যা প্রচার করবেন প্রমাণসহ করুন। ভাসা ভাসা কিছু নয়। আমার বাবা ২২-২৩ বছর ধরে এমপি। আমিও একজন আইনজীবী।
এমপির ছেলের সন্ত্রাসী পুষতে হয় না। মাদক বাণিজ্য করতে হয় না। কারা এসব করছে তার সঠিক খবর নিন। তাহলেই আসল সত্য বেরিয়ে আসবে।’
সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব
আপনার মতামত লিখুন :