সাইদুর রহমান: পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, সর্বপ্রথম ব্যাবিলনীয় সভ্যতার লোকেরা সময়ের হিসাব রাখা শুরু করে। অর্থাৎ ক্যালেন্ডার প্রচলনের ইাতহাস ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে। তাঁরা দিন ও মাসের হিসাব রাখতো মূলত চাঁদের গতিবিধি দেখে। চাঁদের আকৃতি সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। কখনো এক ফালি চাঁদ, কখনো জোছনামাখা ভরাট পূর্ণিমা আবার কখনো অমবস্যার রাতে সম্পূর্ণভাবে তিরোধান। চাঁদের এই ঘটনাগুলো আবার প্রায় ৩০ দিন পর পর পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় চাঁদের এই গতিবিধি বুঝে গিয়েছিলেন তার ফলে চাঁদের উপর ভিত্তি করেই মাস গণনা শুরু করে। হিসাবের সুবিধার জন্য প্রতিটি চান্দ্রমাসকে আবার চন্দ্রকলার ভিত্তিতে কয়েকটি সময়কালে বিভক্ত করা হয়। যেমন-
১। প্রথম দিন: চাঁদ মাত্রই উঠলো একদম এক ফালি চাঁদ। পশ্চিমাকাশে খুব সূক্ষ্মভাবে তাকালে দেখা যায়।
২। সপ্তম দিন: চাঁদের আকার বাড়তে বাড়তে অর্ধগোলকে পরিণত হয়।
৩। চতুর্দশ দিন: চাঁদের আকার বাড়তে বাড়তে পূর্ণ গোলকে পরিণত হয়। চারদিকে ঝলমলে স্নিগ্ধ আলো ছড়ায় এই পূর্ণিমা চাঁদ। এর পর থেকেই চাঁদের আকার ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
৪। একবিংশ দিন: চাঁদের আকার কমতে কমতে আবার অর্ধেকে এসে দাঁড়ায়।
৫। অষ্টবিংশ দিন: চাঁদের আকার ছোট হতে হতে একেবারে সুক্ষ্ম সুতোর মতো হয়ে দাঁড়ায়।
৬। উনত্রিংশ দিন: আকাশে আর চাঁদ দেখা যাচ্ছে না , অম্যবশ্যার রাত এটি।
৭। ত্রিংশ দিন: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজও চাঁদ দেখা যায় না তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দিন নতুন চাঁদের উদয় হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ৭ দিন পর পর চাঁদ একেকটা নতুন এবং চোখে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছাচ্ছে। তাই এই ৭দিন সময়কে চিহ্নিত করে সপ্তাহের উদ্ভব হলো। প্রচলিত ক্যালেন্ডারগুলোতে প্রতি দডববশ’ এ সাত দিন থাকার এটাই মূল কারণ।
সাতদিনের নামগুলো ইংরেজিতে- Sunday, Monday, Tuesday,Wednesday,Thursday,Friday এবং Saturday. এই নামগুলোর উৎপত্তি ঠিক কোন ভাষা হতে ,তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মত আছে। তবে প্রধান মতটি হচ্ছে, ইংরেজি এই বারগুলোর নাম এসেছে স্যাক্সনদের কাছ থেকে। এই স্যাক্সন জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন দেব-দেবীর নামে সপ্তাহের সাতটি বারের নাম রাখে।
১। Sunday: সূর্যের দিন। গ্রিক পুরাণমতে, হেলিওস হচ্ছেন এক শক্তিশালী দেবতা, ইনি সূর্যদেব হিসেবেও খ্যাত। গ্রিক হেলিওস শব্দের অর্থ হচ্ছে সূর্য। রোমান ভাষায় SOI বলতে সূর্যরূপী দেবতাকে বুঝানো হয়েছে, যাকে স্যাক্সন ভাষায় বলা হতো Sunne আর সেখান থেকেই ইংরেজি Sun.
২। Monday: চাঁদের দিন। গ্রিক পূরাণ মতে, Selenes হচ্ছেন চাঁদের দেবী । রোমান ভাষায় এই চাঁদকে বলে Moon. আর সেখান থেকেই ইংরেজি Mon.
৩। Tuesday: গ্রিক শাস্ত্রমতে, Ares নামে এক দেবতা আছেন, যিনি যুদ্ধ আর ধ্বংসের প্রতীক। রোমান ভাষায় অনুরূপ দেবতা হচ্ছেন Mars তবে স্যাক্সনদের ধর্মবিশ্বাস মতে, যুদ্ধ আর ধ্বংসের দেবতা হলেন Tui, সেখান থেকেই ইংরেজি Tuesday.
৪। Wednesday: রোমান মাইথোলজি মতে, ব্যবসা-বাণিজ্যের দেবতা হচ্ছেন Mercury. তবে Wednesday নামটি জার্মান দেবী Woden এর নাম থেকে এসেছে।
৫। Thursday: অ্যাংলো-স্যাক্্রন বিশ্বাস মতে, Thur হলেন থান্ডার বা বজ্রপাতের দেবতা। তাই তার নামে একটি দিনের নাম রাখা হলো Thursday.
৬। Friday: অ্যাংলো-স্যাক্সন বিশ্বাস অনুসারে , ফ্রিগ হলেন সৌন্দর্যের দেবী সেখান থেকেই ইংরেজি Friday নামটির উৎপত্তি ।
৭। Saturday: Saturn’s Day বা স্যাটার্নের দিন। স্যাটার্ন হলেন রোমান দেবতা যিনি খুশি হলে ভালো ফসল দেন কৃষকদেরকে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাষায়, দিনকে বোঝাতে যে শব্দ ব্যবহত হয়, তার অর্থ, স্নানবার সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা সপ্তাহের শনিবার কেবল স্নান করতো, এজন্যই হয়তো এমন নাম।
ভারতবর্ষেও প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষীরা দেবতাদের নামে গ্রহের নাম আর গ্রহের নাম অনুসারে সপ্তাহের প্রতিটি দিনের নাম রেখেছেন।
শনি: হিন্দু পুরাণ মতে শনি এক উগ্র দেবতা। তার কুদৃষ্টি খারাপ ফল নিয়ে আসে।
রবি: রবি মানে সূর্য। হিন্দু পুরাণ অনুসারে সূর্যনারায়ণ বা সূর্যদেবতার নামের ভিত্তিতেই এই সূর্য বা রবির নামকরণ করা হয়।
সোম: সোম মানে চাঁদ। হিন্দু মিথ অনুযায়ী দেবতা শিবের সাথে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
মঙ্গল: হিন্দু মিথ অনুযায়ী মঙ্গল হলো যুদ্ধের দেবতা।
বুধ: বুধ হলো এক ঐশ্বরিক সত্ত্বা।
বৃহস্পতি: বৃহস্পতি হল সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ। হিন্দু ধর্মমতে একে ‘গুরু’ বলা হয়। ইনি যার পক্ষে থাকেন তার ভাগ্য প্রশন্ন হয়।
শুক্র: শুক্র হলো অসুর দেবতাকূলের প্রধান।
সপ্তাহের দিনগুলোর নামের ধারাবাহিকতা যেভাবে হলো:
প্রাচীনকালে পৃথিবী থেকে খালি চোখে যে সাতটি বস্তু দেখা যেতো, জ্যোতিষশাস্ত্রে সেগুলোকে ‘গ্রহ’ বলা হয়।
গ্রহ সাতটি হলো- মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি,শুক্র,শনি, সূর্য ও চন্দ্র।
পৃথিবীর সাপেক্ষে যে গ্রহের গতিবেগ যতো বেশি, সে গ্রহ পৃথিবীর ততো কাছে। অন্যদিকে পৃথিবীর সাপেক্ষে যে গ্রহের গতিবেগ যতো কম , সে গ্রহ পৃথিবী থেকে তত দূরে। দূরত্বের অধঃক্রম অনুসারে সাজালে যে অনুক্রমটি পাওয়া যায়, সেটি এরকম: শনি বৃহস্পতি মঙ্গল রবি শুক্র বুধ সোম।
প্রাচীনকালে বিশ্বাস করা হতো, কেবল সপ্তাহের দিনগুলোর উপর নয় বরং একটি দিনের প্রতি সাত ঘণ্টার প্রতিটি ঘণ্টার উপরও একই অনুক্রমে গ্রহগুলোর প্রভাব রয়েছে। প্রতি সাত ঘণ্টা পর পর অনুক্রমটি পুনরাবৃত্ত হয়। তো, ২৪ ঘন্টার একটি দিনের প্রথম ঘন্টাটি যে গ্রহের প্রভাবাধীন থাকবে পুরো দিনটি সে গ্রহের হবে সে গ্রহের নাম অনুসারে।
ধরা যাক, চন্দ্রমাসের প্রথম দিনের প্রথম ঘন্টা উপর শনির প্রভাব। এরপর দ্বিতীয় ঘণ্টার উপর বৃহস্পতি, তৃতীয় ঘণ্টার উপর মঙ্গল গ্রহের প্রভাব থাকবে। এভাবে যদি হিসাব করেন তাহলে দেখা যাবে, ২৫তম ঘণ্টাটি হলো দ্বিতীয় দিনের প্রথম ঘণ্টা তারমানে দ্বিতীয় দিনটি হবে রবিবার, তৃতীয় দিনটি হবে সোমবার, চতুর্থদিন হবে মঙ্গলবার, পঞ্চমদিন হবে বুধবার , ষষ্ঠদিন হবে বৃহস্পতিবার, সপ্তমদিন হবে শুক্রবার আর অষ্টমদিন হবে শনিবার।
অর্থাৎ, শনি, রবি,সোম,মঙ্গল,বুধ.বৃহস্পতি,শুক্র।
প্রাচীনযুগে এই নিয়মেই সপ্তাহের দিনগুলো ক্রমধারা ঠিক করা হয়েছিল, আজ অবধি সেই নিয়ম চালু আছে।
সম্পাদনায়: বিভুরঞ্জন সরকার।