শাহীন খন্দকার : রাজধানী ঢাকায় রেললাইনের দুই পাশে গড়ে ওঠা বসবাসকারী বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের বিষয়ে স্থায়ী কোনো সমাধান কখনোই হয়নি। যদিও কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি সেই উদ্যোগ। ফলে রেল লাইনের পাশে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন বস্তিবাসী। কয়েকবছর আগেও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন রেল লাইনের পাশের বস্তি উচ্ছেদ করেছিল। বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ করা হলেও আবার গড়ে উঠেছে নতুন বস্তি। আর্থিক বাণিজ্যের কারণে মূলত স্থায়ীভাবে বস্তি উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না বলে অভিমত নগর বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, এই ভাবে বসবাস খুবই বিপজ্জনক। রাষ্ট্রের উচিত, এই মানুষগুলোকে আবাসনের ব্যবস্থা করে অন্য কোথাও দ্রুত সরিয়ে নেয়া।
গত দশ বছরে এই সংখ্যা কত বেড়েছে সেই পরিসংখ্যান এখন পাওয়া না গেলেও সরকারি হিসাবেই ঢাকায় বস্তির সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। মোট কত মানুষ বসবাস করে সেই পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় এই সংখ্যাটা ৪০ লাখেরও বেশি।
আইসিডিডিআরবি’র হিসাবে, ১৯৯১ সালে ঢাকায় বস্তি ছিল দুই হাজার ১৫৬টি, পাঁচ বছর পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭টিতে। আর ২০০৫ সালে তা ৪ হাজার ৯৬৬টিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর নিম্নআয়ের মানুষ অস্বাস্থ্যকর, ঝুঁকিপূর্ণ ও নাগরিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত অবস্থায় বস্তিতে বসবাস করছেন, তারা এখন নগরজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছেন।
রাজধানীর মহাখালী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রেল লাইনের দুই পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে অন্তত দশ থেকে ১৫ হাজারের বেশি পরিবারের বসবাস। এই বস্তিতে বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেটের সুব্যবস্থা নেই। জানাগেছে, রেলওয়ের জমিতে ছাপড়াঘর তুলে ভাড়া দেয় এলাকার প্রভাবশালীরা। এভাবে যেখানে সেখানে গড়ে ওঠে অপরিকল্পিত বস্তি। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, শিক্ষা আর নিরাপত্তাসহ নাগরিক সব সুবিধা বঞ্চিত এই ঘিঞ্জি পরিবেশেই কোনোমতে দিন পার করেন বাসিন্দারা।
নেত্রকোনার সবুজ মিয়া জানান, ৮ বর্গফুটের জায়গার ওপরে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে নিজেই ছাপড়াঘর তুলেছেন। পাশের কয়েকটি ঘর দেখিয়ে বলেন, ৮ বর্গফুটের একটি ঘরের ভাড়া তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। তার স্ত্রী আকলিমা বেগম বলেন, পেটের দায়ে থাকি। এখানে স্বামী ভ্যানে সবজি বিক্রি করে, আমি মেসে রান্নার কাজ করি। এটা দিয়ে সংসার চালাই। কাওরানবাজার রেললাইনের এই বস্তিতে ৫ হাজারেরও অধিক মানুষের বসবাস। এর জন্য পানির কল আছে মাত্র ৫টি। গোসলখানাও ৫টি। এখানে ৫ টাকার বিনিময়ে এক কলস পানি কিনে গোসল করতে হয়। পুরো বস্তির জন্য টয়লেট রয়েছে ৪টি। সেখানে ৫ টাকার বিনিময়ে সিরিয়ালে প্রয়োজন মেটাতে হয়।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, প্রতিবছর অনন্ত পাঁচ লাখ মানুষ ঢাকায় কাজ করতে আসে। এদের মধ্যে সাড়ে তিন লাখই নিম্ন আয়ের। যারা প্রধানত বস্তিতে বাস করে। নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘যারা বস্তিতে আছেন, তারাও এই দেশের নাগরিক। তাদের সহায় সম্বল নেই। তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার পক্ষে নই আমি। আবার তারা যে জমিতে থাকে সেটা অন্যের। অন্যের জমিতে বসাবাসও বৈধ নয়। কিন্তু এরা কী ই বা করবে? এর সমাধান করতে হবে সরকারকেই। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বস্তিবাসীদের সমস্যা সমাধানে কার্যত সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। এটা দুঃখজনক।
রেলওয়ের সূত্রগুলো বলেছে, রেল লাইনের ধারে গড়ে ওঠা বস্তিগুলো সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে রেলওয়ে শ্রমিক সংগঠনের নেতাসহ সরকার দলীয় কিছু নেতা এবং রেলওয়ের অসাধু কর্মকর্তারা। তাই এই বস্তি উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা অদূরভবিষৎতে আছে বলে মনে হয় না। সম্পাদনা : আবদুল অদুদ, সুতীর্থ
আপনার মতামত লিখুন :