ডেস্ক রিপোর্ট : আশির দশকের ঘটনা। এগারো মাসের শিশু জেমি আর হয়তো বড়জোর একটা ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারতো তার জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ যকৃৎ নিয়ে। তার বাঁচার একমাত্র ক্ষীণ সম্ভাবনা নির্ভর করছিল যদি কোনো সুস্থ শিশুর যকৃৎকোথাও পাওয়া যায়। কিন্তু এতো ছোট শিশুর জন্য কোথাও কোন যকৃত পাওয়া যাচ্ছিল না। ঠিক সে সময়টাতেই হাজার মাইল দূরে ছোট্ট এক শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় দশ মাসের শিশু জেসি বেল্লোনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। তীব্র আঘাতের ফলে জেসির মস্তিষ্ক কাজ না করলেও দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো রেস্পিরেটরের সাহায্যে কার্যকর রাখা হয়েছিলো। জেসির বাবা রেডিওতে দিন কয়েক আগেই একটি যকৃতের জন্য জেমির অভিভাবকদের আর্তির কথা শুনেছিলেন। তিনি নিজের মেয়ের অক্ষত যকৃৎটি জেমিকে দান করে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। জেসির রেস্পিরেটর বন্ধ করে দিয়ে তার যকৃৎ সংরক্ষিত করে মিনেসোটায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
জেমির বহু প্রতীক্ষিত অস্ত্রোপচার সফল হয়। জেসির যকৃত জেমি ফিস্ককে দান করল এক নতুন জীবন। ধার করা যকৃৎ নিয়ে জেমি পার করেছে জীবনের ২৪ বসন্ত। শুধু জেমি নয় অন্যের দান করা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রতিদিন নতুন জীবনে ফিরছে বহু মানুষ। কেউ ফিরে পাচ্ছে চোখের দৃষ্টি। আবার কারও বিকল হয়ে যাওয়া কিডনি নব রূপ পাচ্ছে অন্যের দানে। শুধু জীবন ফিরে পাওয়া নয়, মানবদেহের চিকিৎসার উৎকর্ষে ব্যবহৃত হয় মানুষের দান করা দেহ। যাকে বলা হয় মরনোত্তর দেহদান। সারা পৃথিবীতে মরনোত্তর দেহদানকে একটি মহৎ কাজ হিসেবে দেখা হয়। নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের গবেষণার কথা বিবেচনা করেই অনেকে মরনোত্তর দেহদান করে যান। ঢাকা মেডিকেল কলেজে মরনোত্তর দেহদানের জন্য এ পর্যন্ত অঙ্গীকার করেছেন ৬৪ জন। যদিও স্বজন এবং পরিবারের অনীহার কারণে মৃত্যুর পর অনেকের লাশ হাসপাতালে দেয়া হয় না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগের তথ্য অনুযায়ি এ পর্যন্ত মরনোত্তর দেহদান করে যান এমন ৯ জনের দেহ ঢাকা মেডিকেলে দেয়া হয়।
অঙ্গীকারপত্রে সাক্ষর করা ব্যক্তিদের তুলনায় সাক্ষর করা ছাড়া মৃতদেহই বেশি আসে এনাটমি বিভাগে। বিশেষ করে বেওয়ারিশ লাশ, আদালত কর্তৃক হস্তান্তরকৃত লাশও এনাটমি বিভাগে দেয়া হয়। এনাটমি বিভাগের স্টাফ মো. আলী হোসেন জানান, গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগে চাকরি করছেন তিনি। প্রতিবছর গড়ে ৫ থেকে ৭ জন্য ব্যক্তি রেজিস্ট্রেশন করলেও ওভাবে তাদের লাশ আসে না। তাছাড়া রেজিস্ট্রেশন করা বেশির ভাগ ব্যক্তির বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই বয়সটাতে মানুষের ভেতরে প্রচণ্ড আবেগ কাজ করে। ফলে আগে পিছে কিছু না ভেবে তারা সিদ্ধান্ত নেন দেহদানের। এছাড়া অনেক বয়স্ক ব্যক্তি তাদের স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে অভিমান করে দেহদানের রেজিস্ট্রেশন করেন। পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পরে পরিবারের লোকজন আর ওই লাশ হাসপাতালে পাঠায় না। আমরাও এসব লাশের বিষয়ে আর কোনো খোঁজ খবর করি না। আমাদের এখানে যেমন স্বেচ্ছায় রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ আছে। তেমনি রেজিস্ট্রেশন শেষে কেউ যদি লাশ না দেয় সেটা নিয়ে আমাদের কোনো ওজর আপত্তি থাকে না। তিনি বলেন, মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনেকে দেহদান করতে উৎসাহী হন না। আবার অনেক সময় দেহদানের অঙ্গিকার করলেও ধর্মীয় কারণে পরিবার থেকেও বাধা দেয়া হয়।
এনাটমি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. হুমায়রা নওশাবা বলেন, নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন মেনে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারপত্রে সাক্ষর করতে হয়। মারা যাওয়ার পর ওই ব্যক্তির পরিবার যদি নিজ উদ্যোগে লাশ হস্তান্তর করেন তাহলে আমরা গ্রহণ করি। এসকল মৃতদেহ শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার কাজে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান বলেন, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বা পড়ালেখার জন্য মরণোত্তর দেহদান ধর্মে বৈধ বলে জানি। মৃতব্যক্তির শরীর এবং কঙ্কাল থেকে তারা যে শিক্ষা গ্রহণ করে এদিক থেকে দেহদান বৈধ। এতে করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভুমিকা রাখতে পারে। আগে কিছু বিধি নিষেধ থাকলেও এখনতো একজন ব্যক্তির শরীরের অনেক কিছুই দান করা যায়। বিশেষ করে চক্ষু দান, অঙ্গদান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, আমাদের দেশে প্রথম দেহদান করেছিলেন, আরজ আলী মাতুব্বর। এরপর দেহদান করেছেন অধ্যাপক আহমেদ শরীফ, ড. নরেন বিশ্বাস প্রমুখ। এদের সকলের দেহদান করার অর্থটা হচ্ছে মৃত্যুর পরেও মানুষের কাজে লাগা। সবচেয়ে বড়কথা মেডিকেলের ছাত্রদের আগে লাশ কিনতে হতো। কিন্তু এখন যদি আমরা আমাদের মৃতদেহগুলো দেই তাহলে ছাত্রদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কাজে আসবে।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে মরণোত্তর চক্ষু, অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন ২২ জন। মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহদান উৎসাহিত করার জন্য ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তারা এ অঙ্গীকার করেন। দেশে একসঙ্গে এতো মানুষের অঙ্গ ও দেহদানের ঘটনা এটিই প্রথম।
কবি বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠকদের একজন। ২০১০ সালে স্বাধীনতা পদক পেয়েছিলেন তিনি। কেবল মুক্তিযুদ্ধ নয়, বিজ্ঞান, মানবতাবাদ আর যুক্তিবাদও ছিল তাঁর মানস গঠনের অনুপ্রেরণা। কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হয়।
কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর বরাবরই দুঃসাহসী, দুর্বিনীত মানুষ ছিলেন। আরজ আলী বিনা প্রমাণে কিছু মেনে নেননি, প্রশ্ন করেছেন, জানতে চেয়েছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীরাও যে প্রশ্ন করতে ভয় পেতেন, সে সব প্রশ্নগুলো তিনি করে গেছেন অবলীলায়। শুধু জীবিত অবস্থায় নিজেকে আর অন্যদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেননি। তিনি তাঁর মৃত্যুর সময়েও এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তিনি তাঁর মৃতদেহ মানব কল্যাণে দান করার সিদ্ধান্ত নেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখা ‘কেন আমার মৃতদেহ মেডিকেলে দান করেছি’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেন ‘আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিকেল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগণ শল্যবিদ্যা আয়ত্ত করবে। আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিকেলে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানব-কল্যাণের আনন্দ লাভের প্রেরণা।’
আরজ আলী মাতুব্বরের মতো অধ্যাপক আহমদ শরীফও তাঁর মৃতদেহকে মেডিকেলে মানব কল্যাণে দান করে গেছেন। আরজ আলী মাতুব্বরের মৃতদেহ দানপত্রের মতো আহমদ শরীফের সম্পাদিত ( মৃত্যুর চার-পাঁচ বছর আগে) তাঁর ‘অছিয়তনামা’ আর ‘মরদেহ হস্তান্তরের দলিল’ দুটিও বাংলা আর বাঙালির মুক্তবুদ্ধির ইতিহাসে অনন্য কীর্তি। সেখানে তিনি লিখেছিলেন ‘আমি সুস্থ শারীরিক এবং সুস্থ মানসিক অবস্থায় আমার দৃঢ় সঙ্কল্প বা অঙ্গীকার স্থির সিদ্ধান্ত-রূপে এখানে পরিব্যক্ত করছি। ‘মৃত্যুর পরে আমার মৃতদেহ চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের এনাটমি এবং ফিজিওলজি সংক্রান্ত কাজে ব্যবহারের জন্য ঢাকার ধানমন্ডিস্থ বেসরকারী মেডিকেল কলেজে অর্পণ করতে চাই।
‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ খ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ মারা যান ২০১২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি। জীবিত অবস্থায় তিনি জনকল্যাণে মরণোত্তর দেহ ও চক্ষু দানের ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন। ফয়েজ আহমদ মারা যাওয়ার পর প্রদীপ দেব তাঁর ‘ফয়েজ আহমদ: একজন মুক্তমনার প্রতিকৃতি’ শিরোনামের লেখাটিতে লিখেছিলেন,চিরকুমার ফয়েজ আহমদ ব্যক্তিগত সুখের কথা ভাবেন নি কখনো। সারাজীবন মানুষের জন্য গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার জন্য চিরদিন সংগ্রাম করে গেছেন। মৃত্যুর পরেও মানুষেরই কাজে লাগিয়েছেন নিজের শরীর। চোখ দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন দু’জন মানুষের দৃষ্টি। তাঁর চেয়ে মুক্তমনা মানুষ আমরা আর কোথায় পাবো?
তিনদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৪৩ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর মারা যান গায়ক-সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী। তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সাংবাদিকতা আর গানের জগতের লোক ছাড়াও অনেকের কাছেই যিনি শুধু ্তুসঞ্জীবদা্থ নামেই পরিচিত ছিলেন। স্ত্রী প্রজ্ঞা নাসরিন শিল্পী ও মেয়ে কিংবদন্তীকে (৪) নিয়েই ছিল তাদের সংসার। দলছুটের এই জনপ্রিয় গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগে শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজে দান করা হয়। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে তার একটি কংকাল তৈরি করে ঢামেকের এনাটমি বিভাগে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। যেখানে বিভিন্ন সময়ে তার পরিবারের সদস্যরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসেন। দেখে আসেন তাদের প্রিয় মানুষটিকে।
বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার দিন রাতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিনি খুন হন। বইমেলাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেই এ ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে ৪২ বছর বয়সী ব্লগার অভিজিৎ রায়ের মরদেহ পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে দান করা হয়েছে।
গবেষণা থেকে জানা গেছে, মানুষের একটিমাত্র মৃতদেহের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ২২ জন অসুস্থ মানুষ উপকৃত হতে পারে। আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিসের দেয়া তথ্য মতে একটি মৃতদেহের অন্ততঃ পঞ্চাশটি অঙ্গকে নানাভাবে অন্য মানুষের কাজে লাগানো যায়। এ ছাড়াও মেডিকেলের ছাত্রদের জন্য মৃতদেহ উন্মুক্ত করবে ব্যবহারিকভাবে শরীরবিদ্যাশিক্ষার দুয়ার।
২০১৭ সালে চীনে ৫১৪৬টি মানব-অঙ্গদানের ঘটনা ঘটে এবং ১৬ হাজার অঙ্গ-প্রতিস্থাপন সার্জারি করা হয়। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ অঙ্গ নেয়া হয়েছে স্বেচ্ছায় দানকারীদের মৃত্যুর পর তাঁদের শরীর থেকে এবং বাকিগুলো সংশ্লিষ্ট রোগীদের স্বজনদের দান-করা। সারা বিশ্বে বছরে ৬০ থেকে এক লাখ অঙ্গ-প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৭,০৮৫ জন চীনা মানুষ মরণোত্তর দেহ দান করেন।
উৎসঃ mzamin
আপনার মতামত লিখুন :