শেখ নাঈমা জাবীন : ২০১৬ সালে ঢাকার কলাবাগানে দুবর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব তনয়কে। এরপর থেকে বাংলাদেশে সমকামী আর তাঁদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ডয়েচে ভেলে
বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন জুলহাজ মান্নান। ২০১৪ সাল থেকে তাঁর সম্পাদনায় বের হতে শুরু করে এলজিবিটিদের নিয়ে প্রথম পত্রিকা ‘রূপবান’। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের এক বাসায় ঢুকে এই ইউএসএইড কর্মকর্তা ও তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়। তিন বছর পর এসে সম্প্রতি অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোজিম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। দায়ী করা হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের কথিত নেতা সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আটজনকে। ৩৬ বার পেছানোর পর মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০ জুন দিন ধার্য করেছে আদালত।
কিন্তু এই তিন বছরে পরিস্থিতি কতটা বদলেছে? রাষ্ট্রের অসহযোগিতামূলক আচরণে সমকামীদের নিরাপত্তা আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে বলে জানান এই কমিউনিটির সদস্য ও তাঁদের নিয়ে কর্মরত মানবাধিকার কর্মীরা।
অনলাইনভিত্তিক কমিউনিটি ‘ভয়েজ অব বাংলাদেশ’ ২০১৫ সালে ৫৭১ জন সমকামীর ওপর একটি জরিপ চালিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ৫৪ দশমিক তিন ভাগই সব সময় এই ভয়ে থাকেন যে, কেউ হয়তো তাঁদের পরিচয় জেনে ফেলতে পারে। ঐ জরিপে ৬৬ দশমিক ছয় ভাগ জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ পাঁচ জনের কাছে তাঁরা বিষয়টি প্রকাশ করেছেন।
আরেকজন সমকামী নিলয় নীল (ছদ্মনাম) সমকামীদের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, যার নাম নবপ্রভাত। এর যাত্রা শুরু হয়েছে এক বছর হলো। দায়িত্বশীল সদস্য ১১০ জন, এর বাইরে সাতশ’ থেকে আটশ’ জন বিভিন্ন সময়ে তাঁদের সেমিনারগুলোতে অংশ নিয়েছেন বলে জানান নিলয়। ‘যাঁরা নিজেদেরকে অপরাধী ভাবে, পাপী মনে করে, তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে, আমরা স্বাভাবিক মানুষ। সমকামীদের পারিবারিকভাবে নির্যাতনের শিকারই বেশি হতে হয়’।
নিলয় জানান, গত বছর খুলনায় তাঁদের এক বন্ধুকে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। সেই রাতেই সে আত্মহত্যা করে। ‘এরকম অনেক ঘটনাই আছে, যার মধ্যে পারিবারিকভাবে নির্যাতনের ঘটনাই বেশি।’
নিলয়ের মতে, সমাজে মেয়েদের সমস্যা এমনিতেই বেশি, লেসবিয়ান হলে আরো বেশি ভুগতে হয়। তাঁদের কর্মশালায় যোগ দেয়া এক নারী সমকামীর তিন সন্তান রয়েছে। তিনি এখনও স্বপ্ন দেখেন সংসার ত্যাগ করে কোনো নারীর হাত ধরে চলে যাবেন। ‘অনেক লেসবিয়ান নারীকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে,’ বলেন নিলয়।
২০১৫ সালের দিকে বাংলাদেশের সমকামীরা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। কিন্তু জুলহাজ-তনয় হত্যাকান্ডের পর জীবনের নিরাপত্তাই এখন তাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে, এমনটাই জানালেন সমকামী অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী শাহানূর ইসলাম সৈকত। তিনি বলেন, ‘সমকামী কমিউনিটির প্রত্যেকেই এখন লুকায়িত অবস্থায় বা হাইডিং এ আছে। যারাই এক্সপোজ হচ্ছে তাদের উপরই থ্রেটটা চলে আসছে প্রবল আকারে। কাজেই আগে যে অবস্থা ছিল তার চেয়েও এখন খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে।
তাঁর মতে, আগে জঙ্গি হামলার হুমকি ছিল, এর সঙ্গে এখন রাষ্ট্রীয় চাপও যুক্ত হয়েছে। ‘আমরা যারা লেখালেখি করেছিলাম, তাদের কণ্ঠটা রোধ করে দেয়া হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে।’ তিনি অভিযোগ করেন, সমকামীদের নিরাপত্তা দেয়ার ন্যূনতম মানসিকতাও সরকারের নেই৷ উল্টো নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তাঁরা নিগ্রহের শিকার হন।
২০১৭ সালের মে মাসে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে ২৭ জন সমকামীকে আটক করে র্যাব। তাঁদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দিয়ে থানায় হস্তান্তর করা হয়। এই উদাহরণ টেনে নিলয় বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা তো দূরে থাক, উল্টো গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় থাকে। তাঁরা শুধু হোমোসেক্সচুয়ালের মামলা দেয় না, মাদকসহ অন্য মামলাও দিয়ে দিচ্ছে৷
বাংলাদেশ দ-বিধির ৩৭৭ ধারা মোতাবেক সমকামিতা শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। এজন্য দশ বছর থেকে আজীবন কারাদ-, সাথে জরিমানার বিধান রয়েছে। ১৮৯৮ সালের আইন এটি, যার একই ধারা চালু ছিল ভারতেও। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সেটি বাতিল করে সমকামীতা কোন অপরাধ নয় বলে রায় দিয়েছে।
শাহানূর ইসলামের মতে, এই ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক। দেশে এই আইন বাতিলের সহসাই কোনো সম্ভাবনা অবশ্য তিনি দেখেন না। তাঁর মতে, রাজনৈতিক কারণে সরকার এই উদ্যোগ নেবে না। সম্পাদনা : কায়কোবাদ মিলন