রাশেদা রওনক খান : আমার দুর্নীতি সংক্রান্ত পূর্বের পোস্টটি অনেককেই নাড়া দিয়েছে দেখলাম... ইনবক্স ভেসে যাচ্ছে নানা ধরনের দুর্নীতির খবর দিয়ে... এতো রিকুয়েস্ট আসছে যেন অমুক এলাকার অমুক দুর্নীতি নিয়ে লিখি। তাছাড়া কমেন্ট বক্সে অনেক ধরনের আশা জাগানিয়া ও হতাশামূলক মন্তব্য দেখে যা বুঝলাম, তার একটা উত্তর আমার দেয়া দরকার।
প্রথমত, আমরা অন্য কারো দুর্নীতি ধরতে পারলে খুশি, কিন্তু নিজের দুর্নীতি নিয়ে চিন্তিত নই। খারাপ লাগতে পারে কথাটা, কিন্তু উদাহরণ দিলেই দেখবো আমরা নিজেদের খুঁজে পাচ্ছি। যেমন : আমরা হয়তো কেউ কেউ বড় রকমের দুর্নীতি করি না, কিন্তু কোনো কাজ আদায়ের জন্য অফিসে ফাইল টেবিল ঘোরাতে ‘বকশিশ’ দিতে চাই আগে বাড়িয়ে। এটা কি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা নয়? আমরা শহরের ‘ভালো’ স্কুলে সন্তান ভর্তির জন্য কে কি করছি, সেটা আমাদের চেয়ে ভালো কে জানে! আমরা আমাদের পিয়ার গ্রুপের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিতে গিয়ে কে কোন উপায়ে কীভাবে উপার্জন করছি, তাও আমরা বিবেককে প্রশ্ন করলেই পাবো। দুর্নীতি কেবল বালিশ উঠানোতে (এর সত্য-মিথ্যা যাচাই হয়নি এখনো) হয়, আর আমরা সবাই সাধু, এমনটি ভাবার অবকাশ নেই।
আমাদের প্রতি পদে পদে দুর্নীতি, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি যদি একটু দেখি... স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আফজাল (যে কিনা সামান্য কর্মচারী হয়ে অস্ট্রেলিয়াতে বাড়ি বানায় এবং সেখানে ছেলেমেয়ে পড়ায়, ঢাকায় বারোতলা করে কয়েকটা এপার্টমেন্টের মালিক) এর দুর্নীতির রিপোর্ট মিডিয়াতে এলেও আবার কীভাবে এই গ্রুপ টেন্ডার পায় হাসপাতালের আসবাবপত্র কেনার? এই আফজালই ক’দিন পর এমপি নির্বাচনের জন্য নমিনেশন কেনার চেষ্টা করবে! ভাসানটেক রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্টের কাজ কেন বন্ধ? সেখানে কি ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে, কে করছে ভূমি মন্ত্রণালয় তা জানে না? দেশের নানা জায়গায় যেসব প্রজেক্ট হচ্ছে, একেকটায় কি পরিমাণ হরিলুট হচ্ছে, কে করে? বাঁশের বদলে রড দিচ্ছে কিছু ইঞ্জিনিয়াররা, তারা কারা? রাস্তা দুইদিন পর পর ভেঙে যাচ্ছে যাচ্ছে, এসব রাস্তা বানায় যেই ঠিকাদাররা, তারা কারা? ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হয় কারা?
বিটিআরসিতে ড্রাইভিং লাইসেন্স কীভাবে একজন অদক্ষ ব্যক্তি পায়? ড্রাইভারের জায়গায় হেলপার গাড়ি চালায়, লাইসেন্স পরীক্ষা করে কারা? ৫০ টাকার বিনিময়ে সেই হেলপারকে ড্রাইভার হতে উৎসাহিত করে ট্রাফিক পুলিশের অনেকেই, তারা কারা? যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং করে সড়ক সংকট তৈরি করে কারা? কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে বলার পরও বাচ্চাদের কোচিংয়ে নিয়ে যেতে চাই কারা? স্কুলে না পড়িয়ে কোচিংয়ে যেতে বলে শিক্ষকেরা, তারা কারা? ছাত্রদের সংগঠনকে পেশী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে প্রশাসনের উপর খবরদারি করে যেসব এমপিরা, তারা কারা? স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে যৌন হয়রানি করছে শিক্ষকরা, তারা কারা? ভালো মেডিকেল কলেজ হতে পাস করা নবীন ডাক্তাররা ঢাকায় ট্রেনিং, পোস্টিং পায় না, কারণ ধনী-ক্ষমতাবান বাবার ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হতে সার্টিফিকেট ক্রয় করে তদবির বা ঘুষের বিনিময়ে পোস্টিং নিচ্ছে, তারা কারা? বলা হয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়ে টাকা না দিলে কাজ হয় না, সেই টাকা নেয় কারা আর দেয় কারা? দ্বিতীয়ত, এসবই করে সরকার! হ্যাঁ সব দোষ সরকারের! তা সরকার কি কোনো বস্তু না কোনো একজন ব্যক্তি? সরকার তো আমরাই।
তা আমরা না বদলালে দেশ বদলাবে কীভাবে? আর দুর্নীতিই বা কমবে কীভাবে? বদল তো প্রথমে আমাদের হতে হবে। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ তো সরকার করলো, কিন্তু আমাদের শিক্ষকেরা কি বন্ধ করেছি কোচিংবাণিজ্য? না আমরা অভিভাবকেরা আমাদের সন্তানদের কোচিংয়ে যাওয়া বন্ধ করেছি? একটা উদাহরণই যথেষ্ট। চাইলে আরো দিতে পারি। এই যে আমাদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হলো তাতে কি দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির দুর্নীতি করার প্রবণতা কমেছে?
তৃতীয়ত, প্রয়োজন এই ‘আমাদের’ আগে ঠিক হওয়া। দুঃখিত, সরকারকে আমরা বাহাদুর বলতে পারি, কিন্তু সরকারের হাতে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই যে, একদিনই আমাদের চরিত্র ঠিক করে দেবে... কারণ সরকারের ভেতরে বসে আছি এই ‘আমরা’। শেষ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, আমরা নিজেরা যাদের খুব সৎ ভাবছি, তারাও দুর্নীতিবাজদের মতো সুযোগ পেলে কতোটুকু সৎ থাকতে পারবো, তা কেবল তখনই বোঝা যাবে। সুযোগ না থাকলে সৎ থাকা সহজ, কিন্তু সুযোগ থাকার পরও সৎ ও আদর্শে অটল থাকতে পারাটাই হচ্ছে মূলত কঠিনতর কাজ। এই কঠিনতর কাজ এখনও সমাজে অনেকেই করে যাচ্ছেন, তাদেরকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম, ভালোবাসা ও অভিনন্দন। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :