মাসুদ রানা : আজ যে স্থল-জল-অন্তরীক্ষকে আমরা অখ–বাংলা বলে জানি, তার অংশ বিশেষের ‘বঙ্গ’ পরিচয় প্রাচীন যুগে কদাচিৎ মিলে, যদিও এখান থেকে সমগ্র ভারত ও আফগানিস্তানের অংশ বিশেষ শাসন করা এক দারুণ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিলো অষ্টম শতকের থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত, যা পাল সাম্রাজ্য নামে পরিচিত।
স্বদেশী বৌদ্ধ পাল শাসকদের হটিয়ে এদেশে প্রথম বিদেশি শাসক ছিলো দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দু সেনা বা সেনরা, যারা এদেশীয় বৌদ্ধ পালদের হটিয়ে সেন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা বাংলা শাসন করে দ্বাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত। কিন্তু এদেরকে হটিয়ে দিয়ে ১২০৪ সালেএরপর পৃষ্ঠা ২, সারি
(প্রথম পৃষ্ঠার পর) দিল্লির তুর্কি মুসলিম সাম্রাজ্যিক শক্তি তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকেই ‘বাঙ্গালা’ নামের প্রচলন।
অবশ্য সমগ্র বাংলার ‘বাঙ্গালা’ নামে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রিক পরিচয়ের শুরু ‘বাঙ্গালা সালতানাৎ’ থেকে, যেটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৪২ থেকে ১৩৫২ সালের মধ্যে দিল্লি সালতানাৎয়ের বিরুদ্ধে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’ হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে। তখন থেকেই রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ‘বাঙ্গালী’ জাতি-পরিচয় সূচিত হয়। বাঙ্গালার স্বাধীনতা লুপ্ত হয় ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবরের কাছে বাংলার সুলতান দাউদ খান কুররানীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। এর ফলে বাঙ্গালা সালতানাৎ হয়ে উঠে ‘সুবে বাংলা’, যা শেষ পর্যন্ত আপেক্ষিক অর্থে স্বাধীনতা ভোগ করতে শুরু করে ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলি খানের বাংলার নবাব হওয়ার মাধ্যমে। কার্যত স্বাধীন সুবে বাংলা স্বাধীনতা হারায় ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। একপর্যায়ে, ইংরেজরা বাংলা থেকে সমগ্র ভারতকে তাদের অধীনে এনে এবং শেষদিকে দিল্লিতে শাসন কেন্দ্র সরিয়ে নিয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শাসন করে উপনিবেশ হিসেবে।
১৯৪৭ সালে ইংরেজরা যাবার কালে ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ-ভারতকে ভাগ করে যায় ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি রাষ্ট্রে, প্রধানত ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের দাবি মেনে নিয়ে। তখন ভারত ভাগের প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে সমগ্র বাংলার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা পাকিস্তানে, বাঙালি হিন্দুরা দাবি তোলে বাংলা ভাগের। আর তাদের এই দাবি মেনে নিয়ে বাংলাকেও ভাগ করা হয় ধর্মের ভিত্তিতে।
১৯৪৭ সালে বাংলার মুসলিম গরিষ্ঠের পূর্বখ- দেয়া হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে এবং হিন্দু গরিষ্ঠের পশ্চিমখ- দেয়া হয় ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে উভয় খ-ের বাঙালি নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক মনে করতে থাকে কার্যত তাদের ভাষাজাতিক অভিন্ন পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে।
পূর্বখ-ের বাঙালি ১৯৪৮ সাল থেকে বুঝতে শুরু করে পাকিস্তান রাষ্ট্রে তারা বাস্তবে স্বাধীন জাতি নয়। আর তখন থেকেই শুরু হয় বাঙালি জাতির জাতিগত স্বাধীনতার ভাবনা, যা বাস্তব রূপ লাভ করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
পশ্চিম বাংলার বাঙালি ভাষাজনজাতি পরিচয়ের চেয়েও দিল্লিকেন্দ্রিক মুঘল ও ব্রিটিশ শাসনের ঐহিত্যের ধারায় ভারতীয় জাতি-পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবে ভবিষ্যতের জন্য একটি অভিন্ন হিন্দু জাতির মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
আমরা লক্ষ্য করছি, পশ্চিম বাংলার বাঙালি হিন্দু তার ভাষাজনজাতিক আত্মপরিচয় হারাবার একটি ভয়ংকর ঝুঁকিতে পড়েছে। এ ঝুঁকি বুঝতে পেরে অনেকেই তাদের বাঙালি আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তারা ঠিক ১৯৪৭-উত্তর মুসলিম গরিষ্ঠ পূর্ব বাংলার বাঙালির মতো পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন জাতি হিসেবে এখনও ভাবতে শুরু করেনি। হিন্দু গরিষ্ঠ পশ্চিম বাংলার বাঙালিকে যদি নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে টিকে থাকতে হয়, তাদের অতি অবশ্যই মুসলিম গরিষ্ঠের পূর্ব বাংলার বাঙালির ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা যাত্রাপথ অনুসরণ করতে হবে। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :