ড. এমদাদুল হক : মানুষ সম্মান চায়। কখনো কখনো সম্মান পাওয়ার ইচ্ছা, বেঁচে থাকার ইচ্ছা থেকেও তীব্রতর হয়। মানুষ মৃত্যু ভয়ে ততোটা উদ্বিগ্ন থাকে না... যতোটা উদ্বিগ্ন থাকে সম্মান হারানোর ভয়ে। অসম্মানের জীবন থেকে সম্মানের মৃত্যু চয়ন করেও মানুষ নিজেকে সম্মানীত করে। সম্মান প্রাপ্তি ও রক্ষার্থে অর্থ-বিত্ত এমনকি জীবন দিতেও দ্বিধা করে না বহুজন। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যতো অর্থ উপার্জন করে, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করে সম্মান পাওয়ার জন্য। সম্মান রক্ষার্থে জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিসর্জন দিতেও দেখা যায় অনেককে।
সারাজীবন মানুষ সম্মান হারানোর ভয়ে এবং সম্মান অর্জনের প্রচেষ্টায় থাকে। লোকে টাকা, পয়সা, অর্থ-বিত্ত বিসর্জন দেয় সম্মানের জন্য, জীবন বিসর্জন দেয় সম্মানের জন্য। যেখানে সম্মান আছে সেখানে কম বেতনে মানুষ চাকরি করতে রাজি থাকে... যেখানে সম্মান নেই সেখানে বেশি বেতনেও চাকরি করতে রাজি হয় না। তবে কি সম্মান অর্জন করাও জীবনের প্রাকৃতিক লক্ষ্য? কি প্রকারে এই লক্ষ্যের পরিতৃপ্তি হতে পারে?
বাস্তবে জগতের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার আশাই জীবনে সবচেয়ে বড় হতাশার কারণ হয়। মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার আশা জীবনকেই বরবাদ করে দেয়। লোকে জীবন প্রত্যাখ্যান করে সম্মানের আশায়, সুখ প্রত্যাখ্যান করে সম্মানের আশায়। সব আশা মানুষ ছাড়তে পারে কিন্তু সম্মান পাওয়ার আশা ছাড়তে পারে না। জগৎ থেকে সম্মান পাওয়ার আশা দৃষ্টিভঙ্গিকে সংকীর্ণ করে দেয়। ‘আমার হদয় কী বলে’ এর চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় ‘লোকে কী বলবে’ প্রশ্নটি। ফলে সৃজনশীলতা হারিয়ে যায়। জগৎ বড়ই কৃপণ। এখানে সহজে সম্মান প্রাপ্তি ঘটে না। জগৎ সম্মান করে তাকেই যে জয়ী হয়। ফলে সম্মানের আকাক্সক্ষা থেকে জন্ম নেয় প্রতিযোগিতা। উৎপন্ন হয় এমন আত্মবিধ্বংসী মনোভাব যে, জীবন যাক... জয়ী হতে হবে, প্রেম যাক... জয়ী হতে হবে। সততা যাক... জয়ী হতে হবে।
সম্মান পাওয়ার লোভ তীব্র হলে মানুষ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতেই ভুলে যায়... যারা তাকে সম্মান করে তাদের সত্য, আর যারা তাকে অসম্মান করে তাদের মিথ্যা মনে হয়। সম্মান অর্জন করা খুব কঠিন... হারানো খুব সহজ। সম্মান একবার হারিয়ে ফেললে সহজে আর তা ফিরে পাওয়া যায় না। যৎসামান্য ব্যত্যয় সম্মানহানির কারণ হতে পারে। যে মনে সর্বদাই সম্মান হারানোর শঙ্কা কাজ করে সে সে মন থেকে আনন্দ হারিয়ে যায়। অতএব বোঝা যাচ্ছে, বাহ্যজগৎ থেকে সম্মান পাওয়া জীবনের লক্ষ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু সম্মান পাওয়ার ইচ্ছাটা যে মনে আছে, তা তো প্রাকৃতিক! ইচ্ছা যেহেতু আছে ইচ্ছার পরিতৃপ্তিও আছে নিশ্চয়। কী প্রকারে এই ইচ্ছা পরিতৃপ্ত হতে পারে? উত্তর অতি সংক্ষিপ্ত...আত্মসম্মানের মাধ্যমে। যে ব্যক্তি নিজে নিজেকে সম্মান করে না, মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেলেও সে তৃপ্ত হয় না। যে ব্যক্তি নিজে নিজেকে সম্মান করে সে মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেলো নাকি পেলো না, তার তোয়াক্কা করে না। আশ্চর্যজনকভাবে মহাকাল তাকেই সম্মানীত করে।
দুনিয়া মানুষকে যে নগদ মূল্য দেয়... তা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নগদ হারিয়ে যায়। মানুষ নিজেকে যে মূল্য দেয়... সেই মূল্যটিই জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আত্মসম্মান না থাকলে জগৎ থেকে যতো সম্মানই পাওয়া যাক না কেন আত্মগ্লানি, অনুশোচনা, অনুতাপ থেকে মুক্তি মেলে না। যে ব্যক্তি নিজে নিজেকে সম্মান দেয়, সে-ই শাশ্বত সম্মানপ্রাপ্ত হয় এবং ধ্রুব তারার মতো পথ দেখায় দিশাহারা মানবজাতিকে। ফেসবুক থেকে