ডেস্ক রিপোর্ট : হাজার কোটি টাকা মূলধনের প্রতিষ্ঠান হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) দুর্নীতি, অনিয়ম আর পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে ডুবতে বসেছে। ওয়াকফ আইনের তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানটিতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। হামদর্দ নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাকিম মো. ইউছুফ হারুন ভুইয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ আরও তিন পদে আসীন তার তিন সন্তান। বাংলাট্রিবিউন।
হাকিম ইউছুফ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ধর্ম মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। গত ২৩ এপ্রিল গঠন করা এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সংস্থা) মু. আ. হামিদ জমাদ্দার এবং দুই সদস্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সংস্থা) মোহাম্মদ মাহবুব আলম ও সহকারী ওয়াকফ প্রশাসক (উপসচিব) রায়হান কাওছার। তদন্ত কমিটিকে ১ মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
হাকিম ইউছুফের রাজনৈতিক দর্শন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, জামায়াত ও পাকিস্তান কানেকশনের তথ্য উঠে এসেছে কমিটির তদন্তে। ১৯৭২ সালে হামদর্দের গুলিস্তান শাখায় কাউন্টার সেলসম্যান হিসেবে যোগদান করে কীভাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন হাকিম ইউছুফ, তা শুধু তদন্ত কমিটিকেই বিস্মিত করেনি, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও দফতরও বিস্মিত।
হাকিম ইউছুফের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে অভিযোগ জমা পড়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) হাকিম ইউছুফের ক্ষমতার উৎস, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির খোঁজ নিচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব রোর্ডেরও নজরে এসেছে হাকিম ইউছুফের কর্মকাণ্ড।
হাকিম ইউছুফ ও হামদর্দে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তদন্ত ও শুনানি চলছে বলে জানিয়েছেন ওয়াকফ প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, তদন্ত সঠিকভাবেই হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি তিনি।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও হাকিম ইউছুফের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। তবে হাকিম ইউছুফের ছেলে হামদর্দের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. জামাল উদ্দিন ভুইয়া রাসেল দাবি করেন, হামদর্দের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে চায় একটি মহল। ওই মহলের ইন্ধনেই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তদন্ত কমিটির তথ্য বলছে, হামদর্দের (ওয়াকফ) চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদই হাকিম ইউছুফ ও তার পরিবারের দখলে। বড় ছেলে মো. জামাল উদ্দিন ভুইয়া রাসেল হামদর্দের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মেঝ ছেলে সাইফুদ্দিন ভুইয়া মুরাদ পরিচালক (বিপণন) আর মেয়ে হাকিম নারগিস মারজান হিউম্যান রিসোর্স ও ডেভেলপমেন্টের পরিচালক।
গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পরিবারের দখলে থাকায় হাকিম ইউছুফ টেন্ডার ছাড়াই অথবা গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি, মেশিন ও যন্ত্রপাতি ক্রয়, জমি ক্রয়, কনস্ট্রাকশন, কেমিক্যাল ক্রয়, ক্যালেন্ডার-ডায়রি প্রিন্টিং ও প্রকাশনা খাতে দুর্নীতি করছেন বলে তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির তথ্য অনুযায়ী, পরিবারের সদস্যদের বাইরে অন্য পরিচালকরাও হাকিম ইউছুফের আজ্ঞাবহ। হামদর্দের কেনাকাটা ও সরবরাহ পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমেই করান হাকিম ইউছুফ। হামদর্দের প্রচারণায় জটিল রোগের চিকিৎসা হয় বলে দাবি করা হয়। তবে ইউছুফ ও তার পরিবারের সদস্যরা এই চিকিৎসা নেন না; তাদের চিকিৎসা হয় বিদেশে।
তদন্ত কমিটির তথ্য বলছে, স্বাধীনতাবিরোধী হাকিম ইউছুফের বিরুদ্ধে তিন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার তথ্য মিলেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান পুলিশের এএসআই হিসেবে তেজগাঁও থানায় কর্মরত ছিলেন ইউছুফ।
হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের জন্য উপমহাদেশ খ্যাত। হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদ ১৯০৬ সালে ১ আগস্ট দিল্লিতে হামদর্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে এটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান হয়। বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিশেষ ব্যবস্থায় একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাকিম ইউছুফ কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় একটি ‘পুতুল ট্রাস্ট্রি বোর্ড’ গঠন করে ইচ্ছামতো দুর্নীতি করছেন।
জোরালো অভিযোগ রয়েছে, গত এক দশকে প্রতিষ্ঠানটি অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হাকিম ইউছুফ তার দুই ছেলে ও এক মেয়েকে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান হামদর্দকে পরিণত করেছেন ‘ব্যক্তিগত’ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরে জমি, ভবন ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন ইউছুফ। তার নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন লোকসানি ও ঋণখেলাপি হওয়ায় সেটিকে হামদর্দের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। হামদর্দকে বিনাপ্রয়োজনে পাঁচ বছর ধরে ভাড়া দিতে হচ্ছে। বাজারদর অনুযায়ী জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের ভাড়া আড়াই লাখ টাকা। হামদর্দ মাসিক ভাড়া দিচ্ছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা করে। আর ভাউচারের মাধ্যমে আরও ১৫ লাখ টাকা জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনকে দিচ্ছে হামদর্দ।
হামদর্দের টাকায় নিজের মালিকানায় জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন হাকিম ইউছুফ। নারায়ণগঞ্জে (১১৬ মনোহর খার বাগ, মদনপুর, বন্দর থানা) ৭ বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এই ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কারখানা।
ঢাকা থেকে মেঘনা ঘাট যেতে মুগড়াপাড়ার কিছু দূরে নয়াগাঁওয়ে নদীর ধারে আছে ১৭ বিঘা উঁচু জমি।
লক্ষ্মীপুর জেলার দত্তপাড়ায় ৩০ বিঘা জমিতে আছে বিশাল অট্টালিকা, মসজিদ, মাদ্রাসা ও কলেজ। হামদর্দের টাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন মায়ের নামে রওশন জাহান মেডিক্যাল কলেজ ও মাদ্রাসা।
লক্ষ্মীপুর জেলার চর মুটিয়ায় ৬০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় শিক্ষার আড়ালে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ঢাকায় প্রত্যেক ছেলেমেয়ের নামে একাধিক ফ্ল্যাট আছে। বনানী ন্যাম ভবনে (হোল্ডিং ২বি, ফ্ল্যাট-বি৩, ব্লক-আই, রোড-১) হাকিম ইউছুফের নিজের নামেও রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। সেগুনবাগিচায় (৬৭৫, পাইওনিয়ার রোডে) ৮ কাঠা জমির ওপর আছে আরও একটি বাড়ি।
তদন্ত কমিটির তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে তৎকালীন ওয়াকফ প্রশাসক নূরুল হুদাকে আড়াই কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে হাকিম ইউছুফ ‘মোতওয়াল্লি কমিটি’ গঠন করেন। এর আগে ধর্ম মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে হামদর্দ পরিচালিত হয়ে আসছিলো। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নিয়ম ভঙ্গ করে মোতওয়াল্লি কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য হলো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অবাধ দুর্নীতিকে আড়াল করা এবং পছন্দমতো ও পরিবারের লোকজনকে নিয়ে হামদর্দ পরিচালনা করা।
তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, তৎকালীন ওয়াকফ প্রশাসক নূরুল হুদা সম্প্রতি অবসরে যান। হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে তিনি মাসিক ৩ লাখ টাকা বেতনে চাকরি করছেন। তার নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়মনীতি উপেক্ষা করা হয়েছে। এবং এ সংক্রান্ত কাজের কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়াই নিয়োগ পান নূরুল হুদা।
তদন্ত কমিটির তথ্য বলছে, হাকিম ইউছুফ স্বাধীনতাবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তেজগাঁও থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মৌলভী ফরিদ উদ্দিনের সহায়তায় তিনি পুলিশে যোগ দেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনে প্রশিক্ষণ শেষে এএসআই হিসেবে নিয়োগ পান। তার কর্মস্থল ছিল তেজগাঁও থানায়। মৌলভী ফরিদের নেতৃত্বে তিন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যায় সরাসরি অংশ নেন ইউছুফ। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাবেক কর্মী হিসেবে তৎকালীন ছাত্রসংঘের সভাপতি মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিনের সঙ্গে ইউছুফের ঘনিষ্ঠতা ছিল। মাইনুদ্দিন বর্তমানে লন্ডনে বসবাস করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে হামদর্দের গুলিস্তান শাখায় কাউন্টার সেলসম্যান হিসেবে যোগ দিয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়া হাকিম ইউছুফের উত্থান তদন্ত কমিটিকে বিস্মিত করেছে। স্বাধীনতাবিরোধী গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ এই সহযোগীকে বিচারের আওতায় আনতে সুপারিশ করা হবে বলে তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে।
আপনার মতামত লিখুন :