লিয়ন মীর : সুভাষ সিংহ রায়কে আমরা সাধারণত একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবেই টেলিভিশনের পর্দায় উপস্থিত হতে দেখে থাকি। কখনো টকশোর অতিথি বা কখনো উপস্থাপক, এটা দেখেই আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এছাড়াও তার নামের সঙ্গে আরো যে কয়েকটি পরিচয় যুক্ত আছে এবং তিনি ভীষণ মেধাবী তা পরিচিতজন এবং কাছের মানুষেরাসহ দেশের অগণিত মানুষ জানে। কিন্তু তিনি যে একজন ভীষণ বইপ্রেমী বা বইপাগল মানুষ, তা আর ক’জনে জানে।
বইপ্রেমী সুভাষ সিংহ রায়ের বাইয়ের সংগ্রহ ছুঁয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার। দেশি-বিদেশি লেখকদের গল্প-উপন্যাস, কবিতা, দর্শন, জীবনী, ইতিহাসনির্ভর এবং রাজনৈতিক বইসহ সব ধরনের বই আছে তার ব্যক্তিগত বইয়ের লাইব্রেরিতে। এছাড়াও বসার ঘর, শোবার ঘর, খাবার ঘর, ঘুমের ঘর সবখানেই শুধু বই আর বই। বাসায় গেলে আপনার মনে হতে পারে ভুল করে লাইব্রেরিতে এসে পড়েছেন।
কোন ধরনের বই আপনাকে টানে বা আপনি পচ্ছন্দ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমার জন্য কঠিন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। আমি যা পাই তাই পড়ি, যা দেখি তাই লিখি। হয়তো সব কথা বলতে পারি না। তবে কিছু কথা আজকের জন্য লিখছি আর কিছু কথা ভবিষ্যতের জন্য লিখছি। সেগুলো জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে প্রকাশ করার ইচ্ছা নিয়ে সংগ্রহে রেখে দিয়েছি।
তিনি বলেন, বই পড়া আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমি সব ধরনের বই পড়ি। বই পড়ার ক্ষেত্রে ভালো-মন্দের বাছ-বিচার করতে পারি না। জিয়াউর রহমানকে নিয়েও আমি গভীরভাবে পড়াশোনা করেছি। তাকে নিয়ে যতোগুলো বই বেরিয়েছে প্রায় সবগুলো বই আমার পড়া শেষ এবং আরো পড়ার আগ্রহ রয়েছে। এটা আমাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে।
সুভাষ সিংহ বলেন, আমি কখন যে বই পড়ি আর কখন যে পড়ি না, তা ঠিক করে বলা মুশকিল। জেগে জেগে পড়ি, ঘুমাতে যাওয়ার আগে পড়তে পড়তে ঘুমাই। হাতে বই নিয়েও মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি। আবার মাঝে যখন ঘুম ভেঙে যায় তখনও বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টাই। পড়ার মাঝেই আমার বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে যে বইগুলো পড়েছি, সেই বইগুলো এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। হেঁটে হেঁটে বই হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে বহুবার ড্রেনের মধ্যে পড়ে গিয়েছি। বই পড়ার ক্ষেত্রে আমার কাছে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই।
একই রকমের বই আমি বেশিক্ষণ পড়তে পারি না। একইসঙ্গে আমি একাধিক বই পড়ি। একটা বই পুরোটা শেষ করে নতুন একটা শুরু করবো সেটা আমার দ্বারা হয় না। দেখা যাচ্ছে কোনো বইয়ের ২০ পাতা পড়ে রেখে দিয়েছি, কোনো বইয়ের অর্ধেক আবার কোনো বইয়ের শেষ দিকে গিয়ে অন্য বই ধরেছি। এভাবেই একসঙ্গে নানা স্বাদের একাধিক বই আমি পড়ে শেষ করি। এটা বলা যায়, ছোটবলার বই পড়ার মতো। তখন যেমন আধাঘণ্টা অঙ্ক করতাম, আধাঘণ্টা ইংরেজি পড়তাম আধাঘণ্টা বাংলা পড়তাম তেমন করেই আমি এখন বইয়ের স্বাদ বদল করে পড়ি। আমি যখন বই কিনি তখন কখনোই কোনো বই একটা কেনা হয় না। একই বই কমপক্ষে দুই-তিনটা কেনা হয়। পরিচিত এবং প্রিয় মানুষদের আমি এই বইগুলো উপহার দিয়ে থাকি। আমি জানি যে, আমি একা পড়লে হবে না। অন্যদেরও পড়তে হবে। বিশেষ করে আড্ডায়-গল্পে যেন তারা সমান অংশগ্রহণ করতে পারে সেজন্য তাদের আমি বই উপহার দিয়ে থাকি। সবার যদি একই বিষয়ে জানা থাকে তাহলে আলোচনা করতে সুবিধা হয়।
একটা সময় উপন্যাস খুব পড়তাম, এখন আর উপন্যাস তেমন টানে না। হঠাৎ হঠাৎ স্বাদ বদলানোর জন্য উপন্যাস ধরা হয়। এখন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং ইতিহাসনির্ভর বই বেশি পড়া হয়। সেইসঙ্গে যোগ হয় নতুন নতুন আত্মজীবনী। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই। পৃথিবীর যেখানেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নতুন বই বের হবে, এক সপ্তাহের মধ্যে আমার সেই বই হাতে পেতেই হবে। তার জন্য আমি মরিয়া হয়ে যাই। আপনারা এখন আমার যা বই দেখছেন এই বই সংগ্রহ শুরু করেছি আমি ১৯৭৬ সাল থেকে। তখন আমার বয়স ১১ বছর। বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুলের উপর যতো বই বের হয় তার সব আমার কাছে পাওয়া যাবে।
আপনার প্রিয় বই কোনটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই জবাব দেয়া মুশকিল। কোনোভাবেই কি সম্ভাব নয়? হ্যাঁ এটা বলতে পারি- আমাকে সবসময় গীতাঞ্জলি টানে। যদিও আহম্মদ ছফা বলেছেন- সবার কাছে গীতাঞ্জলি শ্রেষ্ঠ কাব্য। আর আমি বলি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’। তিনি এখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের কথা বলেছেন।
মানুষের সকল দঃখ, কষ্ট, চাপাকান্না, ক্ষোভ, মান-অভিমানের সমাপ্তি ঘটাতে পারে বই। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চাইলে সবাইকে বই পড়তে হবে। বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। দেশকে, বিশ্বকে , অন্যকে জানতে হলে বই পড়তে হবে, জানার একমাত্র পথ হচ্ছে বই। এমনকি নিজেকে জানতে চাইলেও বই পড়তে হবে। বই ছাড়া নিজেকে জানাও অসম্ভব। এক কথায় বলা যায় সমস্ত জ্ঞানের উৎস হচ্ছে বই। লোক আর মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সেই পার্থক্য গড়ে দেয় বই। তাই এক কথায় বলতে পারি মানুষ একবার বইয়ের মাঝে মিশে গেলে সে আর বেরিয়ে আসতে পারবে না।
আপনার মতামত লিখুন :