ডেস্ক রিপোর্ট : শনিবার গভীর রাতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শনির হাওরের লালুর গোয়ালা বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে ডুবে গেছে পাকা ধান- সমকাল
অরক্ষিত উপকূলীয় এলাকার সাড়ে চার কোটিরও বেশি মানুষ। দুর্যোগ-দুর্বিপাক প্রতিবছরই আঘাত হানে উপকূলে। আসে সিডর-আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধের বেশিরভাগই এখন নাজুক হয়ে পড়েছে। অনেক এলাকায় বাঁধের কোনো অস্তিত্বও নেই। উপকূলের বেড়িবাঁধ সংস্কার ও মেরামতের নামে প্রতিবছর চলে সীমাহীন দুর্নীতি। সরকারি অর্থের হয় হরিলুট। কিন্তু হয় না স্থায়ী শক্তিশালী বেড়িবাঁধ। সব সময়ই অভিযোগের তীর দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। কার্যকর বিচারও হয় না সংশ্নিষ্টদের।
ঘূর্ণিঝড় ফণীর বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু আতঙ্ক কাটেনি উপকূলবাসীর। কারণ, ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে জোয়ারে ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে নিমজ্জিত হয়েছে উপকূলের বহু এলাকা। বেড়িবাঁধ ভেঙে তালিয়ে গেছে ফসলের জমি ও জনবসতি। ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করছে বরগুনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও খুলনার উপকূলের মানুষ। সাগর, পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বরের জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। বেড়িবাঁধ না থাকায় বর্ষাকালের স্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয়ে দেখা দিয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা।
এ বিষয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম জানান, ঘূর্ণিঝড় ফণীতে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো দ্রুত পুনর্মেরামত করা হবে। উপকূলে কীভাবে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা যায়, তারও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সিডরের ১২ বছর পরও দক্ষিণাঞ্চলের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার হয়নি। সিডরে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলোর বেশিরভাগ এখনও আগের মতোই আছে। বাঁধগুলো দিয়ে অল্প জোয়ারের পানি ঢোকে ফসলি জমিতে। মিঠাপানির উৎসও পুনঃস্থাপন হয়নি। সিডরকবলিত শরণখোলা, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, বরগুনা, তালতলী, কলাপাড়া, গলাচিপা, চরখালীসহ অন্যান্য এলাকায় এখনও বহু মানুষ ঘর পায়নি। তারা এখনও বেড়িবাঁধের ওপর বাস করছে। জেলেদের অবস্থা আরও করুণ। তারা যে জাল ও ট্রলার সাহায্য হিসেবে পেয়েছিলেন, তার বেশিরভাগই ব্যবহার করতে না পেরে বিক্রি করে দিয়েছেন। রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট।
ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের অন্তত ৪২৪ কিলোমিটার বাঁধ। এ অবস্থায় নদীকে উত্তাল হয়ে উঠতে কিংবা আকাশে মেঘ দেখলেই ভাঙন আতঙ্কে আঁতকে ওঠে উপকূলের মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, খুলনা অঞ্চলে ৩৬৫ দশমিক ২৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে সংস্কারের অভাবে অন্তত ১০৯ কিলোমিটার বাঁধের অবস্থা জরাজীর্ণ। পাউবো খুলনা-২-এর ৫১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৪৫ কিলোমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন বলেন, খুলনা ও সাতক্ষীরার এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাগেরহাটের প্রায় ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। স্থানীয়দের আশঙ্কা, বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে পারে শতাধিক গ্রাম।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সুপার সাইক্লোন সিডরে দক্ষিণের ৩০ জেলার দুই হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত হয়, যার মধ্যে একেবারেই বিলীন হয় ৩৯১ কিলোমিটার। এক হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতি হয়। ওই বাঁধ মেরামতের জন্য পাউবো দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু সামান্য পূর্ণিমার জোয়ারে ভেঙে যায় এসব বাঁধ। সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেও বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে দিনযাপন করে উপকূলের মানুষ।
সিডর ও আইলায় পটুয়াখালী জেলার ক্ষতিগ্রস্ত ২৮৫ কিলোমিটার বাঁধের মেরামত সংস্কার হয়নি এখনও। পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, জেলার ১২টি পোল্ডারের অধীনে মীর্জাগঞ্জ, গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলায় ৬০ কিলোমিটার বাঁধ এখনও অরক্ষিত। গলাচিপার চালতাবুনিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুর রহমান মিয়া জানান, তাদের ইউনিয়নের চারদিকে নদী। বাঁধ না থাকায় পানি বাড়লেই ডুবে যায় বাড়িঘর। ক্ষতি হয় ফসলের। ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডরের ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারে সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও অর্থ সহায়তা করেনি উন্নয়ন সহযোগী অধিকাংশ দাতা সংস্থা। প্রতিশ্রুতির সিকিভাগও পায়নি বাংলাদেশ।
সাগর ও নদীবেষ্টিত উপকূলীয় জেলা বরগুনায় এখনও জোয়ারের পানি সামান্য বেড়ে গেলেই নিম্নাঞ্চলসহ বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসকারীদের বাড়িঘর, ফসলি জমি তলিয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় রান্নাবান্না। জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে আশ্রয় নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বরগুনার উপকূলীয় এলাকার মানুষ বসবাস করছে। বলেশ্বর তীরবর্তী পোটকাখালী আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ জহির জানান, জোয়ারের পানি সামান্য বেড়ে গেলেই ঘরে পানি উঠে যায়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর বন্যা থেকে উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় দক্ষিণের ছয় জেলায় নির্মাণ করা হবে ৬২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। যার খরচ ধরা হয়েছে তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার ১৭টি পোল্ডারে নির্মিত হবে বেড়িবাঁধ।
গতকাল রোববার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শনে গেছেন। তারা বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। উপকূলবর্তী এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তারা।
কয়রা ও দাকোপ: মেরামত ও সংস্কারকাজে ঠিকাদারের ফাঁকি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঠিক নজরদারির অভাবে বারবার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা ও দাকোপ। গত শুক্রবার রাতে ঘূর্ণিঝড় ফণী বাংলাদেশে প্রবেশে আগেই দুই দফায় ভাঙন ধরে কয়রা সদরের কপোতাক্ষ নদের ঘাটাখালী গ্রাম এলাকায়। আর গত তিন মাসে তিন দফা ভেঙেছে পশুর নদের দাকোপ উপজেলার বানীশান্তা ইউনিয়নের বাজার এলাকা। গতকাল রোববার সকালেও ওই এলাকার বাঁধ ভেঙে গেছে। অবশ্য স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় বাঁধ মেরামত করা হয়েছে।
দাকোপে বার বার বাঁধ ভাঙা সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, মোংলা চ্যানেলের জোয়ারের পানি সরাসরি এই বাঁধে আঘাত করে। এ ছাড়া জোয়ারের পানির স্রোত স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যাওয়ায় বাঁধটি বার বার ভেঙে যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা: পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় ৫৫৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে। ফণীর প্রভাবে শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা, পদ্মপুকুর ও মুন্সীগঞ্জ বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন ধরেছে। কপোতাক্ষ নদের প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে গাবুরা গ্রামে অধ্যক্ষ রুহুল কুদ্দুসের বাড়ির সামনে দুই কিলোমিটারব্যাপী পাউবো বাঁধ নদীতে ভেসে গেছে। এ ছাড়া বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাঁতিনাখারী প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা যে কোনো সময় ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দ্রুত বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করেছে।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, ঝড়ের আঘাতে ইউনিয়নে ২৭ কিলোমিটার পাউবো বাঁধের অধিকাংশ স্থানের ক্ষতি হয়েছে। পদ্মপুকুর ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, ঝড়ের আঘাতে নদীতে প্রবল ঢেউয়ে ইউনিয়নের কামালকাটি হাবলী থেকে স্লুইস গেট পর্যন্ত খোলপেটুয়া নদীতে ধসে গেছে। মুন্সীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মোড়ল জানান, ফণীর আঘাতে ইউনিয়নে বড়ভেটখালী মোস্তফা সরদারের বাড়ির সামনে ৫০০ ফুট এলাকাজুড়ে মীরগাং নদীতে ধসে গেছে। পাউবো-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান বলেন, সাতক্ষীরার দুই ডিভিশনের আওতায় মোট ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে পাউবো-২ এর আওতায় ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিতে আছে। সেগুলো সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখেছি। এই বেড়িবাঁধকে স্থায়ীভাবে সংস্কারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বাজেট পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পটুয়াখালী: সিডরের ১৫ বছরেও পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের পায়রা নদীর পাড়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি। ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে প্রবলবেগে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে উপজেলার দেউলি সুবিদখালী ইউনিয়নের চরখালী, মেন্দিয়াবাদ, হাজিখালী, রানীপুর ও গোলাখালীসহ পাঁচ গ্রাম এবং মির্জাগঞ্জ সদর ইউনিয়নের রামপুর, কিসমত রামপুর, ভিকাখালী ও সন্তোষপুরসহ পাঁচ গ্রামে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় এসব গ্রামের মানুষের বাড়িঘর ও ফসলি জমিসহ বিস্তীর্ণ জনপদ। পানিবন্দি হয়ে পড়ে মানুষজন। বর্তমানে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুর জামান বলেন, মূলত পায়রা নদীর ভাঙনের কারণে ২০১৮ সালে এ বেড়িবাঁধটি ভেঙে গেছে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা হয়। কিন্তু জমির মালিকরা জমি দিতে রাজি নন। তাই ওই এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা আর সম্ভব হয়নি।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম গতকাল রোববার সকালে মির্জাগঞ্জের চরখালী, মেন্দিয়াবাদ, হাজিখালী, রানীপুর ও গোলাখালী এলাকার বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেছেন এবং বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলো দ্রুত মেরামত করার আশ্বাস দেন।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন- পটুয়াখালী প্রতিনিধি মুফতী সালাহউদ্দিন, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি এম কামরুজ্জামান, দাকোপ প্রতিনিধি ও কয়রা সংবাদদাতা।
সূত্র : সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :