ড. এমদাদুল হক
মহাকালের সিঁড়িটি কোনদিকে? সবদিকে। কিন্তু একজন যদি সবদিকে যায়, তবে কোনোদিকেই যায় না। সে শুধু ঘুরে আর ঘুরে। সবকিছু একটু একটু জানার চেষ্টা করলে কিছুই জানা যায় না। একটি ভালো করে জানলে সবকিছুই একটু একটু জানা হয়ে যায়। সব পথেরই নিজস্ব মূল্য আছে, কিন্তু মূল্য বুঝতে হলে সব সামর্থ্য চলার পথে নিয়োগ করতে হয়। মূল্য পদ্ধতিতে থাকে না, মূল্য থাকে ব্যক্তির আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ঐকান্তিকতায়। যে যেই পথই চয়ন করুক না কেনÑপথ ব্যক্তির বিকাশ স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া চাই। দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ পথই ব্যক্তির বিকাশস্তর বিচার বিবেচনা না করে শুরুতেই এমনকিছু করার জন্য প্ররোচিত করে, যার সঙ্গে জীবনের সম্বন্ধ নেই, যেগুলো একেবারেই সম্প্রদায় ও গোত্রভিত্তিক আনুষ্ঠানিকতা। অধুনা বেশিরভাগ আধ্যাত্মিক পথ ধ্যান ছাড়া আর কিছু বোঝে না। অধ্যাত্ম উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানের কলা-কৌশল শিক্ষা দিতে শুরু করে কিংবা ধ্যান শিক্ষণের বিজ্ঞাপন দিয়ে অধ্যাত্ম আকর্ষণ করে। কিছু কিছু সুফী গোত্র আবার শুরুই করে সমর্পণ দিয়ে। প্রথমে সমর্পিত হওÑপরে শিক্ষা নাও। গাছে কাঁঠাল গোফে তেল। যা সর্বশেষ পদক্ষেপ তা দিয়েই শুরু করার আত্মপ্রবঞ্চনা। কিছু দরবার ব্যস্ত থাকে লেবাস নিয়ে। দরবার কিংবা আশ্রমে প্রবেশ করার পূর্বেই বিশেষ বস্ত্র পরিধানের জন্য বাধ্য করা হয়। মাথা মু-ন, বাবরি চুল কিংবা দাড়ি রাখা, টুপি পরার মতো নগণ্য বিষয় নিয়ে মাতামাতি শুরু করে। অনেক অধ্যাত্মার আগ্রহই থাকে লেবাসের প্রতি। লেবাস ধারণ করে সে চিত্তপ্রসাদ লাভ করে যে, সাধু হয়ে গেছে। সত্যিকারের অধ্যাত্মা কখনও লেবাস দ্বারা নিজেকে চলমান বিজ্ঞাপনে অধঃপতিত করে না। প্রত্যেক মার্গেরই শুরুর দিক রয়েছে, যদি তা মার্গ হয়। টেনিস খেলা শিখতে হলেও প্রথমে দেওয়ালের সঙ্গে খেলতে হয়। বল নিয়ে মাঠে নামার আগে অনেক প্রচেষ্টা, অনেক অনুশীলন, অনেক বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করতে হয়। দেহ ফিট, মন ফিট না হলে খেলা শুরু করা যায় না। সম্যক মার্গ চয়ন করার পূর্বেও কিছু প্রস্তুতির দরকার। চিত্ত কিছুটা শুদ্ধ ও স্বচ্ছ হওয়া দরকার, যেন ঠিক-বেঠিক দেখা যায়, ভালো-মন্দ বোঝা যায়। প্রত্যেক মার্গের প্রথম পদক্ষেপগুলো এমন হওয়া চাই যেন জাতি ধর্ম বর্ণ অঞ্চল লিঙ্গ বয়স শিক্ষা স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য গ্রহণীয় হতে পারে। যেন প্রত্যেক মন তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়, যেন তাতে সাম্প্রদায়িক গন্ধ ও রহস্যময়তা না থাকে। বীজ বপন করার পূর্বে যেমন জমি উত্তমরূপে চাষ দিতে হয়, আগাছা পরিষ্কার করতে হয় তেমনি সম্যক মার্গ চয়ন পূর্বে কিছু কাজ সবাইকেই করতে হয়। যেমন :
দৈহিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য : আহার, নিদ্রা, মৈথুনে নিয়মানুগ অভ্যাস গঠন এবং আলসেমি, নিষ্ক্রিয়তা ও শ্রমবিমুখতা বর্জন।
মানসিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য : পরনিন্দা, পরচর্চা বর্জন, আড্ডাবাজি ও গল্পগুজব থেকে বিরত থাকা, অবমাননাকর ও ক্রুর ভাষার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, অসার ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বর্জন, সমালোচনা, দোষারূপ, ছিদ্রান্বেষণ থেকে বিরত থাকা।
আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য : দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন, জীবনযাপনে সমন্বয়, সততা ও ক্ষমার অনুশীলন। এই কয়েকটি সাধারণ কাজ করতে পারলে দেহ মন আত্মা ঊর্ধ্বারোহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। সম্যক প্রস্তুতি যার থাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার সম্মুখে সম্যক মার্গ উপস্থিত হয়। সম্যক গুরু তাকে খুঁজতে হয় নাÑবরং সম্যক গুরুই তাকে খুঁজে নেন। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :