ইকবাল আনোয়ার
কেনরে ভাই, আমরা তো এক মাটিরই সন্তান। দলিত মথিত হয়েছি একসাথে। আমাদের সে কি কষ্ট। সব একাকার হয়ে কাই হয়ে গেছি দুজনায়। মিহি হবার প্রয়োজন পড়েছিলো বলে আমাদের মালিক, শ্রমিক লাগিয়ে এহেন অবস্থা করেছিলো আমাদের। চালান দেবে বলে, নগর গড়বে বলে! আমাদেরকে বলেছিলো, গাঁও গেরামে কে থাকে পড়ে, ক্ষেত হয়ে ক্ষেতের মাটিতে। এখানে বর্বর আর মূর্খতার বাস। যাবে নগরে। কতো আধুনিক আর রং-বেরঙয়ের শোভা মনলোভা। দেখবে সেখানে! তাই দলিত হয়েও ফলিত হবার বাসনায় সব সয়েছি। তুই আমাকে আর আমি তোকে সান্ত¡না দিয়েছি। ‘আর একটু কষ্ট কর ভাই, কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলে না’।
যে দিন গায়ে আগুন দেয়, সে দিনওতো গায়ে গা লেগে ছিলাম দুজনে। জলন্ত কয়লা আমাদের মাাটির দেহকে জ্বালিয়ে লাল করে দিলো। আর্তনাদ করতে পারলেও বাতাসে দীর্ঘশ্বাসের সাথে জলন্ত জীবনের হাহাকার বের হয়ে হালকা করতো নিজেদের কয়েদ-কষ্টকে। কিন্তু তারও উপায় ছিলোনা। কেবল স্তুপীকৃত সমগোত্রীয় নিরব বেদনার এক জাহান্নাম যেন আমাদের নিয়তি। ধোয়ার আঁধারে চোখ থাকতেও আমরা অন্ধ হয়ে নিয়তির বিধানকে মেনে নিয়েছিলাম সেদিন। আর বরাবর তুই আমাকে আর আমি তোকে বুকে আগলে রেখেছিলাম। বড় একাকার। বড় ভাগাভাগি হাহাকার। এসবের মধ্যেও এটাই যেন এক বিন্দু স্বর্গসুখের আকার।
তারপর আগুন নিভে গেলো একসময়। অসার হয়ে গেলো দেহ মন। করাত করাত শব্দে আমাদেরকে রেখে দেয়া হলো হাজত খানায়, স্টেক দিয়ে। এখানেও আমরা পাশাপাশি। স্তরে স্তরে সমগোত্রীয়দের কয়েদবাসে আমরা ভালোই ছিলাম বলতে হয়। কেননা তখন বাতাস পেতাম, আলো আঁধার পেতাম। দিনে সূর্য রাতে চন্দ্র। জোছনা, বৃষ্টি, ঝিঁঝির ডাক, সব কিছুই ছিলো মনোরম। আমরা দুজন যেন পরানের বন্ধু- সুহৃদ জন্মজন্মান্তরের। তখন কে জানতো এই সুখ সইবে না আমাদের।
একদিন, কি কুলক্ষণে দিন, দুটি ট্রাক এসে দুজনকে দুই ট্রাকে তোলে নিলো, হায়। আমি দেখি তুই নাই, তুই দেখস আমি নাই। এ যুদা কেমন যুদা! আকাশও পারবেনা এ বিচ্ছেদের ভার বইতে। হায়রে জীবন। একদিন মাটি ছিলাম। গাছের শিকড়ে জড়ানো মায়ের মতোন শিক্ত মাটি। ফল ফুলের গাছ আকাশে দুহাত মেলে ধরতো আমাদের উপর ভরসার ঠাঁই এঁকে। আমরা সন্তানের মতো ধারণ করতাম তাদের। কি সুগন্ধ তখন জীবনের, কি মায়া কি স্নেহ। কার পাপে কে গন্ধম খেয়ে আমাদের করেছে বাগানের বার। তারপর জ্বলছি পরতে পরতে দেহে আর মনে। তবুওতো তুই ছিলি বলে জীবনের একটা অর্থ ছিলো! আজ দেখি সব গেলো। এর চেয়ে মরণ ঢের ভালো, আরো ভালো ‘নাই’ হওয়া।
বন্ধু, প্রাণের নাগর আমার, শুনতে পেলাম দূত মারফত, তুই নাকি ধর্মশালার মেঝে হয়েছিস। পুন্যবানদের কপাল পরে তোর গায়ে। তাদের হৃদয়ের আতরদান থেকে, পুন্য চক্ষু থেকে সুগন্ধ পাস নিত্য, আর কি যে তোর সম্মান! শোনে তোর জন্য গর্ব হয় ভীষণ, কষ্ট তো কম করসনি জীবনে। আর আমার কথা নাইবা শুনলি, আমি পেসাবখানার মেঝে হয়েছিরে, সিনেমা হলের। লোকে এসেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চর চর করে ছেড়ে দেয় মদ হাসিস গাঁজার গন্ধভরা হিসু। আমি যতোনা যাতনা পাই, লজ্জায় মরি আরো ততো।
আচ্ছারে পোড়ামাটি- ভাই, কোােন কিছুর আভাস কি পাস! আমি কিন্তু নিত্য স্বপ্ন দেখি। দেখি একটা বিপ্লব, একটা রেঁনেসা আসছে ধেয়ে। দুরে হলেও দেরী নেই। কাছে যদিও নয়, তবু আসছে পাছে পাছে। সেদিন সব এক হবো। কেনরে পোড়ামাটি- বোন, কি কারণে অথবা কোনো এক অপ্রচ্ছন্ন মনে না পড়া, বোধে না ধরা, নিয়তির পুর্বধারী সুত্রদোষে আমার জীবনের এমন মরণ! ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :