কাজী নুসরাত : ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে, বা হাত করে শঙ্কাহরণ.......রবীন্দনাথের কল্পিত সাহসের প্রতিবিম্ব যে নারী, মা তথা দেশ মাতৃকা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব তিনি জাহানারা ইমাম। তাঁর সমধিক পরিচিতি শহীদ জননী হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার কণ্ঠ। আজ তাঁর ৯১তম জন্মবার্ষিকী।
অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে ১৯২৯ সালের ৩রা মে জাহানারা ইমামের জন্ম। বাবা আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। পারিবারিক অনুক‚ল পরিবেশের সুবাদে জাহানারা রক্ষণশীল নারী সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। বিয়ের পর প্রকৌশলী স্বামী শরীফ ইমামও তাঁকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট অনুপ্ররণা যুগিয়েছেন ।কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন থেকে বি.এ পাস করে পরবর্তীকালে প্রাইভেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ করেন জাহানারা ইমাম। কর্মজীবনে তিনি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল ও ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সত্তরের দশকের শেষ দিকে শিক্ষকতা ছেড়ে প্রগতিশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান রুমী গেরিলা অপারেশনে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাহানারা ইমাম নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, খাবার ও অস্ত্র সরবরাহ, সংবাদ আদান-প্রদান সহ নানা কাজে অংশ নিয়েছিলেন। এ সময়কার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বেদনা, স্বপ্ন সব তিনি লিখে রেখেছিলেন ছোট ছোট চিরকুটে। এই ঘটনাবৃত্তান্ত নিয়েই রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ যুদ্ধদিনের শিহরণমূলক ও মর্মস্পর্শী ঘটনার অসামান্য দলিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণাধিক পুত্র রুমী শহীদ হলে শোক-বিহ্বল জাহানারা ইমাম হয়ে ওঠেন লক্ষ লক্ষ শহীদের বেদনাভারাক্রান্ত মাতৃহৃদয়ের প্রতীক, হয়ে ওঠেন শহীদ জননী। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতারিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে তিনি নানাভাবে গণসচেতনতা গড়ে তোলায় সচেষ্ট ছিলেন। ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক কমিটি’, ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ প্রভৃতি সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। লেখালেখিও করেছেন বিস্তর। অনবদ্য গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ ছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাপঞ্জির মধ্যে রয়েছে: ‘অন্য জীবন’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘চিরায়ত সাহিত্য’, ‘বুকের ভিতর আগুন’, ‘দুই মেরু’, ‘নিঃসঙ্গ পাইন’, ‘নয় এ মধুর খেলা’, ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’, ‘প্রবাসের দিনলিপি’ ইত্যাদি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬শে জুন জাহানারা ইমাম প্রয়াত হন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামে আজও তিনি প্রেরণার অনন্য উৎস।
আপনার মতামত লিখুন :