অসীম সাহা : পাকিস্তান আমলে আমরা যখন ঢাকায় আসি, তখন ঢাকা ছিলো পত্রপল্লবসুশোভিত একটি সবুজ নগরী। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। রমনা পার্ক, বেলী রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা-কোথায় না সবুজ ছিলো? দেশ স্বাধীন হবার পরও এই সবুজের সমারোহে চোখ জুড়িয়ে যেতো। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যেমন ধূসর হতে থাকে, তেমনি মনে-প্রাণে অবাঙালি জিয়াউর রহমান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর স্টাইলে ঢাকা শহরে গাছ কাটার মহোৎসব শুরু করেন।
নিউমার্কেটের সামনের দক্ষিণ গেটে যে বিশাল বিশাল গাছ ছিলো, যার নীচে গাড়ি পর্কিংয়ের ব্যবস্থা ছিলো এবং ছিলো পথচারীদের জন্য ছায়ার নিবিড় আলিঙ্গন; জিয়া তাকে এক সিন্ধান্তে এমনভাবে জবাই করতে শুরু করেন, যাতে ঢাকা শহরের সবুজের সৌন্দর্য ম্লান থেকে ম্লানতর হয়ে ক্রমাগত আরব দেশগুলোর আকার ধারণ করতে শুরু করে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রমনা পার্কের ধার ঘেঁষে যে বড় বড় মেহগনি গাছগুলো ছিলো, তাকে কুঠার আর করাতের আঘাতে মাথা নুইয়ে দিতে তার বেশি সময় লাগেনি।
তবে পরিবেশবাদী, ছাত্রসমাজ ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর তীব্র প্রতিবাদের মুখে তার পক্ষে সবগুলো গাছ খতম করা সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলাদেশকে মরুভূমির দেশে পরিণত করার তার খায়েস পূরণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার আগেই তিনি যেখানে এখন শিশুপার্ক, সেখানে স্বাধীনতাযুদ্ধে যার ভূমিকাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘ইন্দিরা মঞ্চ’ নামে একটি মঞ্চ তৈরি করেছিলেন এবং যেখান দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই স্থানটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য জিয়া সেখানে শিশুপার্ক প্রতিষ্ঠা করেন, যা আসলে শিশুদের বিনোদনের জন্য নয়, ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে বিলুপ্ত করে দেবার জন্য।
যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন এবং যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৮০০০০ হাজার সৈন্য যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হয়েছিলো, তার স্মৃতিচিহ্ন যাতে একেবারেই না থাকে, সবুজসৌন্দর্যের বিরোধী জিয়া সেই কাজটিই করেছিলেন। সেখানে একের পর এক গাছ পুঁতে সবুজের প্রতি তার দরদ দেখানোর নামে আসলে তিনি পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঢেকে দিতে চেয়েছিলেন। সেই যে শুরু, এরপর থেকে সবুজবিরোধী অভিযান চলছেই। ঢাকা শহর বিস্তৃত হয়েছে, সরেছে সবুজ। আর আমাদের নগরকল্পনাবিদরা তো ফানুসবিদ। তাদের পরিকল্পনামাফিক ঢাকা শহর নগরে পরিণত হয়ে উত্তরা পার হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত পেরিয়ে গেলেও কোথাও কোনো পরিকল্পনার ছাপ তো দূরের কথা একটি পরিও পাওয়া যায় না।
ঢাকার শহরে অপরিকল্পিত বাড়ি, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, অপরিকল্পিত যানবাহন চলাচল-এর জন্য কারা দায়ী? আমরা সকলে। জনগণ, রাজউক, মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন, ওয়াসা, ওয়াপদা, সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, আমলা মায় মেয়র পর্যন্ত। যদি প্রশ্ন করা হয়, ঢাকা শহরে চলাচলের জন্য শুধু দ্বিমুখী রাস্তা কেন? কেন দু’লেইনের রাস্তা? পুরান ঢাকার কথা বাদ দিলাম, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কেন বহু লেনের রাস্তা তৈরি হয়নি? ঢাকা শহরে অনেকগুলো উড়ালপুল হয়েছে। কিন্তু যেখানে গিয়ে গাড়ি নামছে, সেখানে কেন ডাইভারশন রোড নেই? এ-প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই। তাই ঢাকা এখন ১নং যানজটের নগরী। জানজট করার জন্য এই যানজটই যথেষ্ট। পরিবার পরিকল্পনার অন্য পদ্ধতি কাজে লাগছে না বলে এখন আগুন, সড়কদুর্ঘটনা, অবশেষে যানজটের জানজটে মৃত্যুর নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মোক্ষম পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে!
এর ওপর আমাদের দুই পাশের দুই মেয়র প্রতিযোগিতা করছেন, কে কার চেয়ে বেশি কথা বলতে পারেন। সাঈদ খোকন বহুবার বলেছেন, পুরান ঢাকাকে তিনি এমন করবেন, যা আয়নার মতো ঝকঝক করবে। হকার উচ্ছেদের হুমকি তো ইতিমধ্যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণকে আবর্জনামুক্ত রাখার জন্য তিনি কোটি কোটি টাকা খরচ করে ডিব্বা বানিয়ে রাস্তার পাশে ময়লা ফেলার জন্য রেখেছিলেন। হিরুঞ্চিরা সেসব দখলে নিয়ে ধোলাইখালে গিয়ে কবরস্থ করেছে।
এরপরও মেয়র খোকন থেমে নেই। এবার তিনি বলেছেন, নতুন ওয়ার্ডগুলোকে তিনি মডেল শহর বানাবেন। খোকন সাহেব কি জানেন, মডেল শহর কাকে বলে? যে শহরগুলো থেকে অন্যরা অনুপ্রাণিত হবেন? তো বানাবেনই যখন, তখন বানিয়ে দেখান। এতো কথা বলার দরকার কী? যারা কাজ করেন, তারা নিরবেই করেন, বেশি কথা বলেন না। সে-কথা কে শোনেন? শোনেন না বলেই এবার মাঠে নেমেছেন আতিকুল ইসলাম, উত্তরের দীর্ঘাঙ্গ মেয়র। তিনি বলেছেন, তিনি নাকি ঢাকা শহরকে প্রাচ্যের সুইৎজারল্যান্ড বানাবেন। হাসবো না কাঁদবো, ঠিক বুঝতে পারছি না।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, কদিন আগে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় গিয়েছিলাম। ছোট্ট শহর। ছিমছাম। রাস্তাগুলো দেখলে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরাও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে। কেউ নিয়ম ভাঙে না। আতিক সাহেব সেখানে গেছেন কিনা জানি না। যদি না গিয়ে থাকেন, তা হলে বলবো, একটু ঘুরে এসে আপাতত আপনি না হয় ঢাকা শহরকে আগরতলা বানিয়ে দেখান, তারপর প্রয়োজনে সুইজারল্যান্ড বানাবেন। আর কথা একটু কম বলেন। দুই মেয়রকেই বলি, এ-কথাটা নিশ্চয়ই আপনাদেরও জানা আছে “সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর।” অতএব কথা না বলে মুখ বন্ধ করে কাজ করে প্রমাণ করুন, সুইৎজারল্যান্ড নয়, আপনারা অন্তত একটি আগরতলা হলেও তৈরি করতে পেরেছেন!
লেখক : কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :