খোকন আহম্মেদ হীরা : দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সড়ক পথে যোগাযোগের একমাত্র ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে দিন দিন বেড়েই চলছে দুর্ঘটনা। এর কারণও মোটামুটি চিহ্নিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো স্থায়ী সমাধানে আসতে পারছেন না। সচেতন মহলের দাবি-রাজনৈতিক দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতার কারণে ও প্রশাসনের উদাসিনতায় এ সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা।
বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত তিন বছরে বরিশালের সড়ক ও মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগই হচ্ছে থ্রী-হুইলার মাহিন্দ্রার কারণে। লাইসেন্সবিহীন চালকরা বেপরোয়া গতিতে যাত্রী নিয়ে এ যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হচ্ছেনা।
বরিশালের একাধিক বাস চালকরা জানান, হাইকোর্ট থেকে মহাসড়কে থ্রী-হুইলার যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও তা বীরদর্পে চলছে। সিগন্যালের বালাই নেই এ যান চালকদের কাছে। যে যার ইচ্ছেমতো চালাচ্ছে, ওভারটেক করছে আবার আকস্মিক থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে। বিষয়টি প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা অবগত থাকলেও স্থায়ী কোনো সমাধান না হওয়ায় দুর্ঘটনার প্রতিরোধ করাও সম্ভব হচ্ছেনা। আর এতে করে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। পঙ্গুত্ববরন করেছেন অনেকে। সস্প্রতি সময়ে বরিশাল-বানারীপাড়া সড়কের গড়িয়ারপারে থ্রী-হুইলারের সাথে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন সাতজন। আহত চারজনকে সুস্থ্য হতেও অনেক সময় লাগবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেপরোয়াগতিতে দূর্ঘটনাকবলিত মাহিন্দ্রাটি মহাসড়কের রং সাইডে এসে বিপরীতদিক থেকে আসা যাত্রীবাহি পরিবহনের সাথে ধাক্কা খাওয়ার কারণেই দুর্ঘটনার শিকার হয়। ফলে মাহিন্দ্রার চালকসহ সাতজন নিহত ও চারজন গুরুতর আহত হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্যস্ততম মহাসড়কে প্রশিক্ষণ বিহীন চালক থ্রী-হুইলার চালানো অবস্থায় যাত্রীরা যেখানে বসে সিগন্যাল দেয় সেখানেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সিগন্যাল ছাড়াই মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থ্রী-হুইলার মাহিন্দ্রায় যাত্রী উঠানোর কারণে ইতোমধ্যে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে। সচেতন বরিশালবাসী নিয়ন্ত্রনহীন বেপরোয়াগতির এ যানবাহন বরিশালের ব্যস্ততম বিশেষ করে দূরপাল্লার সড়কগুলোতে নিষিদ্ধ করে তা কার্যকর করার জন্য জোর দাবি করেছেন।
বাস শ্রমিকদের অভিযোগ, ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে মহাসড়কে থ্রী-হুইলার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও সেই নিষেধাজ্ঞা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, মহাসড়কে থ্রী-হুইলার মাহিন্দ্রা চললে মাসোহারা পেয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট থানা ও হাইওয়ে পুলিশের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারা। আর যার পেছনে শেল্টারদাতা হিসেবে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতা। যে কারণে নিষেধাজ্ঞা কাগজে-কলমেই চাঁপা পরে রয়েছে। আর এতে করেই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক হয়ে প্রায় ১৪টি অভ্যন্তরীন রুটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থ্রী-হুইলার মাহিন্দ্রা বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে থাকে। এছাড়া রূপাতলী বাস টার্মিনাল থেকে ঝালকাঠি, বাকেরগঞ্জ, নলছিটি ও লাহারহাট রুটেও চলাচল করে থ্রী-হুইলার মাহিন্দ্রা। এসব রুটে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনার খবর শোনা যায়। যার বেশিরভাগই থ্রী-হুইলারের কারণে হয়ে থাকে। বাস ও ট্রাকের সাথে থ্রী-হুইলার যান পাল্লা দিয়ে চলাচলের কারণেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
নথুল্লাবাদের বাস শ্রমিকরা জানান, বরিশাল থেকে যে কয়টি রুটে বাস চলাচল করে সেই রুটগুলোতেই মাহিন্দ্রা চলাচল করে থাকে।
বেপরোয়াগতিতে এসব থ্রী-হুইলার মাহিন্দ্রাগুলো চলাচলের কারণেই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। আর রহস্যজনক কারণে এদের বিরুদ্ধে সহসা পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করছেনা।
মাহিন্দ্রা চালক ছাত্তার মিয়া বলেন, অধিকাংশ মাহিন্দ্রা চালকের লাইসেন্স রয়েছে। লাইসেন্স না থাকলে তো পুলিশ মামলাই দিতো। বরিশাল নগরী থেকে আমাদের গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তাহলে এখন আমরা গাড়ি চালাবো কোথায়।
বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. ইউনুস আলী খান জানান, থ্রী-হুইলার মাহিন্দ্রার কারণে বাস চালানো দুস্কর হয়ে উঠেছে। বেপরোয়াগতির মাহিন্দ্রার কারণে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। আর এ যানগুলোর বেশির ভাগ চালকেরই নেই লাইসেন্স কিংবা প্রশিক্ষণ। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের কাছে আমরা অনেকবার অভিযোগ দিয়েও কোনো সুফল পাইনি।
ইউনুস আলী খান বলেন, নিষেধজ্ঞার পরেও মাহিন্দ্রাগুলো যেভাবে চলাচল করছে তাতে সামনে আরও প্রাণহানি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে এখনই প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বিষয়টি আমরা মাসিক আইন শৃঙ্খলা সভায়ও বলেছি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বরিশাল জেলা মাহিন্দ্রা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি লিটন মোল্লাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিফ না করায় কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার খায়রুল আলম বলেন, মহাসড়কে থ্রী-হুইলার চলাচল বন্ধে আমরা প্রতিদিন অভিযান চালিয়ে মামলা দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু মূলকথা হচ্ছে শহরের মধ্যে থেকে যদি একটি বাইপাস সড়ক থাকতো তাহলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ভালো হতো। আর এ গাড়িগুলোও মহাসড়কে চলাচল করতোনা।
জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে মাহিন্দ্রা বা থ্রী-হুইলার যান চলাচলের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে জেলা পুলিশ। তবে এগুলো যে মহাসড়কে একেবারেই চলেনা সেটা বলব না। আমাদের সামনে পরলে এই যানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা থেকে শুরু করে বিপুল অংকের টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। পাশাপাশি যদি কোনো পুলিশ অফিসার টাকার বিনিময়ে এ যানগুলো ছেড়ে দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেয়া রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এসব থ্রী-হুইলার যানেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে দ্রুতগামী বাস বা ট্রাকের সড়কে নয়। এজন্য আমাদের আরও সচেতনতা দরকার।
আপনার মতামত লিখুন :