আবু ফরহাদ
বঙ্গবন্ধু তার জীবতকালে অনেক বিশেষণে বিভূষিত হয়েছেন, মৃত্যুর পরেও। বঙ্গবন্ধু শব্দটি হয়তো তার তার সবচেয়ে বড় বিশেষণ যেটি তার নামেই পরিণত হয়ে এখন নাম বাচক বিশেষ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শব্দটি অনন্য বা ইউনিক কোডেও পরিণত হয়েছে, কেননা এই শব্দটি আর কোনো মানুষকে পরিচয় দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। বঙ্গবন্ধু বললে শুধু একজন মানুষকেই চেনা যায়। বঙ্গ এবং বন্ধু দুটি আলাদা শব্দ, কিন্তু দুটি শব্দ একসঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি সমাসবদ্ধ শব্দে পরিণত হয়েছে। কীর্তিমান এই মানুষটি বাঙালি জগৎ ও জীবনকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে বাংলা ব্যাকরণকে ও কিছুটা নাড়া দিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শব্দটি ভালোবাসা ও আবেগ মিশ্রিত শব্দ। কিন্তু এখন তার মৃত্যুর পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্মান বোধ। তাকে সম্মানিত করার শব্দ। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক নানা বিভক্তির জালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসাবে তাকে স্বীকৃতি দেবারও শব্দ এটি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির মহান নেতা, এ জাতীয় নানা বাক্যের ব্যবহারে হয়তো তাকে সম্মানিত করা যায়, কিন্তু ছোট বঙ্গবন্ধু শব্দটির তুলনা হয় না। এ শব্দটি বাঙালির সঙ্গে তার সম্পর্কও প্রকাশ করে। কী রকম মানুষ কিংবা কী রকম নেতা ছিলেন তিনি এটা বোঝাতে বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারিত হলে আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে ধারণা দিতে। মহান নেতা শব্দ দুটিতে একটা উচ্চতা বোধ আছে। মহান নেতা আরও থাকতে পারেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, নেতাজী সুভাষ বসু, দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাশ, মওলানা ভাসানী এমন আরো অনেকই বাঙালির মহান নেতা ছিলেন যাদের নামও বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে। এই মহান নেতা শব্দের উচ্চতার বিপরীতে বঙ্গবন্ধু শব্দে আছে সমতা, কাছাকাছি একজন কেউ, যার নিকটবর্তী হওয়া যায়, যার কাছে দুঃখ-সুখের কথা বলা যায়। বঙ্গবন্ধু শব্দে আছে একটি আটপৌরে ভাব যেন সবার মতোই একজন ঘরের মানুষ, একজন উদার চিত্ত, হৃদয়বান, দরদী বাঙালি মানব সন্তান। নেতা শব্দটি যতোই আমরা বলি, নেতা শব্দটি অনুসারীদের সঙ্গে একটি দূরত্ব আপনা আপনিই তৈরি করে। নেতা শব্দটির মধ্যে একটা মান্যতার বিষয় যেমন আছে, তার সঙ্গে আছে সম্মানজনক দূরত্বে অবস্থানের বিষয়ও। নেতার বন্ধু হয়ে উঠার বিষয়টি নিতান্তই মহানুভবতার, অসাধারণ ঔদার্যের। নেতার বন্ধু হওয়ার পথটি ও অনেক কষ্টের। কিছু সহকর্মীর বন্ধু নয়, সকল মানুষের, গণমানুষের বন্ধু হওয়া অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। কতো ইগো বাদ দিতে হয়, কতো পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্যকে ত্যাগ করতে হয়, কতো অবসরকে ভুলে যেতে হয়, কতো মানুষের কতো কথা কতো অসময়েও শুনতে হয়, মনোযোগ দিতে হয় কতো অপ্রয়োজনীয় বিষয়েও। কাউকেও তো অখুশি করার সুযোগ নেই, আপ্যায়নে আদরে সবার গায়েই হাত বুলাতে হয়। না হলে বন্ধু হয় কীভাবে? বঙ্গবন্ধু নেতা থেকে বন্ধু হয়েছেন। নেতা তিনি ছিলেন তবে বন্ধু তার বড় পরিচয়, বঙ্গবন্ধু । বন্ধুর কথা শুনলে একজন অসহায় মানুষ ও সাহস খুঁজে পায়, একজন হতাশ মানুষ প্রেরণা ফিরে পায়। বঙ্গবন্ধু শব্দটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেরণার একদম অন্তর্নিহিত শক্তি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সারাক্ষণই উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শব্দটি নানা কারণে-অকারণে। বিশ্ববাসী হয়তো শেখ মুজিব বা শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলেছে, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ইত্যাদির সংবাদে উচ্চারিত হয়েছে এ নাম বাঙালি কিন্তু উচ্চারণ করেছে বঙ্গবন্ধু । বঙ্গবন্ধু একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমার্থক নাম। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আবেগ তৈরির নাম। বঙ্গবন্ধু নামের আবেগে তৈরি হয়েছে রণকৌশল। রণাঙ্গনে, শৃঙ্খলিত স্বদেশে সর্বত্রই মানুষের হৃদয়ে উপস্থিত ছিলো বঙ্গবন্ধু শব্দটি। বঙ্গবন্ধু শব্দটি দ্রুত আবেগ সঞ্চারিত করেছে গণমানুষের মধ্যে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শব্দটি মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য তৈরির নাম। না হলে ঊনসত্তরের নির্বাচনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং সকল প্রাদেশিক সংসদীয় আসনে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর মার্কা জিতে যায় কীভাবে? বঙ্গবন্ধু শব্দটি মানুষে মানুষে মৈত্রী তৈরির নাম। বঙ্গবন্ধু সাত মার্চের কবির নাম। সাত মার্চের বিশাল ঐতিহাসিক জনসভাটি বঙ্গবন্ধুর নামেই হয়েছিলো। তখন বঙ্গবন্ধু শব্দটি ছাডা আর কোনো নাম, আর কোনো বিশেষণ, বিশেষ্য উচ্চারিত হয়নি। জনতা বঙ্গবন্ধুকে শুনতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো রেস কোর্সে, আর কোনো নামের জন্য নয়। বঙ্গবন্ধু শব্দটি সৃষ্টি করেছিলো সাত মার্চ আর সাত মার্চের মোহনীয় কবিতাটি। যে কবিতাটি পরে সারা বাংলাদেশকে বজ্রকণ্ঠে নিনাদিত করেছিলো। বঙ্গবন্ধু শব্দটিতে লুকিয়ে আছে বজ্র কণ্ঠ । আরো একটি বাক্যে বঙ্গবন্ধুকে বিশেষিত করা হয়। ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। ক্ষণজন্মা তো বটেই, এ রকম একজন মানুষের কতো বছর পর আবার জন্ম হবে জানি না! কিন্তু মহাপুরুষ শব্দটিতেও দাঁড়িয়ে আছে মানুষের ঊর্ধ্বে কোনো কিছু, মহাজাগতিক কেউ হয়তো। তা ছাড়া আরো একটি বাক্যও বহুল ব্যবহৃত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। হাজার বছরের অনন্য বাঙালি তো বটেই, বাঙালিপনায় শ্রেষ্ঠদের নিঃসন্দেহে একজন, কিন্তু এই বাক্যটির মধ্যে গৌরবটা যেন একটু বেশি হয়ে গেলো অথচ বঙ্গবন্ধু শব্দটি একজন নিরঅহংকার মানুষের ছবিকে ধারণ করে, আচরণে ও বিশ্বাসে। বঙ্গবন্ধু শব্দটি একদম বাংলার পলিমাটির গন্ধকে যুক্ত করে। আসলেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন হাজার বছরের বাংলার কাদাজলে বেড়ে উঠা গাঁ গেরামের বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে একজন আপনজন, যিনি শুধু শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনার নন, তিনি সকল বাঙালির আপনজন। বঙ্গবন্ধু বিত্ত বৈভবের সঙ্গে কখনো ছিলেন না। আটপৌরে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও শীততাপ যন্ত্রবিহীন ধানমন্ডির অরক্ষিত সাধারণ বাড়িতে থেকেছেন, শীততাপ যন্ত্রবিহীন গাড়িতে চড়েছেন। বঙ্গবন্ধু চিত্ত বৈভবেই সকল বাঙালির বন্ধু হয়েছিলেন। বন্ধু কী জীবনের কোনো পর্যায়ে বন্ধুত্বকে ছিন্ন করতে পারে ? তাহলে কী আর বন্ধু থাকা যায়? ছাত্র জীবনের বন্ধু শাহ আজিজের বন্ধুত্বকে যেমন তিনি যতœ করেছেন, তেমনি রাজনীতির নেতা ও বন্ধু খাঁন এ সবুর, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মশিহুর রহমান যাদু মিয়াদের মতো মানুষদেরও তাদের গভীর দুর্দিনে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই ঘোরতর বিরুদ্ধবাদীদেরও তিনি তার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন তাদের জেল বাসের সময়ও। একজন বন্ধুর যা যা করা উচিত তিনি তাদের জন্য সবই করেছিলেন অন্য অনেকের অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও। তিনি যথার্থই বন্ধু ছিলেন সকল বাঙালির, তিনি সত্যি বঙ্গবন্ধু। এই একটি ছোট শব্দই এ মহাপ্রাণ, ক্ষণজন্মা বাঙালির পরিচিতি তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। আরও একটি বিশেষণ আমার খুব পছন্দের। এটি ব্যবহার করতেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবুল ফজল। তিনি প্রায়শই বঙ্গবন্ধুর নামের আগে ‘শালপ্রাংশুদেহী’ শব্দটি লিখতেন। শালপ্রাংশু মানে শাল গাছের মতো লম্বা দেহের অধিকারী। শাল গাছের দেহ পুরুষ্ট, মেদ বাহুল্য বর্জিত এবং দীর্ঘ। বঙ্গবন্ধুর সন্দর্শনে তার সাহিত্যিক মানসে একরকম অসাধারণ আশ্চর্যবোধ ও সম্মানের মিশেলে আরেকজন অনন্যসাধারণ বাঙালির শারীরিক দৈর্ঘ্যকেই শুধু তিনি বোঝাতে চাননি, তার শরীরের চাইতেও বড় তার মহত্ত্ব, উদারতা ও সুবিশাল দীর্ঘ হৃদয়কেও বোঝাতে চেয়েছেন। নেতাকে তো উচ্চতায় আর সবার চাইতে বড় হতেই হবে, কারণ ঝড় ঝাঁপটা তো শালপ্রাংশুর মতো দীর্ঘ নেতার গায়েই লাগতে হবে প্রথম। আবুল ফজল এই শালপ্রাংশুদেহী বাঙালিটিকেই বাঙালির যথার্থ নেতা মানতে রাজি ছিলেন। মহান উদার নেতা বোঝাতে তিনি শাল গাছের উচ্চতার এই ইমেজারি তৈরি করেছিলেন।
এতো কথা বলার পরেও বঙ্গবন্ধু ছাডা আর কোনো শব্দের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে চাইনে। বঙ্গবন্ধুই এই মহান নেতার উচ্চতা, বিশালতা, উদারতা, মহত্ত্ব বোঝানোর সবচেয়ে উপযুক্ত শব্দ।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবসে বিখ্যাত সাহিত্যিক, ছড়াকার, সাবেক আইসিএস কর্মকর্তা অন্নদা শংকর রায়ের বিখ্যাত চরণ দুটির উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের বঙ্গবন্ধু তর্পণটি শেষ করি।
‘যতোদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান,
ততোদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
আপনার মতামত লিখুন :