রুহুল আমিন : রুমী আক্তার, শারীরিক প্রতিবন্ধী এই বিধবা থাকেন রাজধানীর বনানীর কড়াইলের বেলতলা বস্তিতে। ছুটা বুয়া হিসেবে কাজ করেন দুটি বাসায়। তা থেকে মাসে আয় হয় মোট আড়াই হাজার টাকা। তবে ঘর ভাড়া দিতেই চলে যায় এক হাজার ৬০০ টাকা। বাকি ৯০০ টাকা দিয়ে বর্তমান বাজারমূল্যে পুরো মাস চলা যে কত কঠিন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অভাবের তাড়নায় তাকে অধিকাংশ রাতই কাটাতে হয় দু’মুঠো মুড়ি খেয়ে। সমকাল।
একটু ভালো থাকার আশায় তিন হাজার টাকা খরচ করে প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে সরকারের ভাতাভোগী তালিকায় নাম উঠিয়েছিলেন হতদরিদ্র রুমী। বর্তমানে এই ভাতার হার মাসে ৭০০ টাকা। কিন্তু এ টাকাও প্রায় আড়াই বছর ধরে পাচ্ছেন না তিনি। অবশ্য সরকার থেকে তার ভাতা বরাদ্দ ঠিকই আসে। তবে তা তার হাতে পৌঁছায় না। ভাতার টাকা আত্মসাৎ করে নেয় শাহনাজ আলী, যে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে প্রতিবন্ধী ভাতা তালিকায় রুমীর নাম উঠিয়েছিল। রুমী জানিয়েছেন, ভাতার বইটিও নিজের কাছে রেখেছে শাহনাজ।
শুধু রুমী আক্তারের প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা নয়, এমন অনেক নারী পুরুষেরই বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা আত্মসাৎ করে আসছে শাহনাজ। শত শত ভাতাভোগীর ভাতা বই নিজের কাছে আটকে রেখে তাদের কাছ থেকে কমিশন আদায় করে। এমনকি মৃত ব্যক্তিদের নামেও ভাতা উঠিয়ে আত্মসাৎ করে সে। ভাতাভোগীর নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সে দেড় হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। শাহনাজের মতো সালমা, মনি হাওলাদারসহ আরও কয়েকজন রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে বনানী ও কড়াইল এলাকার বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর কাছ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বনানীর কড়াইল বস্তির অন্তত ৫০ জন ভাতাভোগীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহনাজ সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বা কর্মচারী নয়। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে পারেন, এমন নারী-পুরুষদের টার্গেট করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট অফিসের মাধ্যমে তালিকায় নাম ওঠাতে 'মধ্যস্থতাকারী'র কাজ করে সে। এ জন্য তারা টার্গেট ব্যক্তিদের কাছ থেকে এককালীন দেড় হাজার থেকে সাত হাজার টাকা এবং পরে প্রতি কিস্তিতে কমিশন নেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শাহনাজ বাস করে রাজধানীর গুলশান থানার কালাচাঁদপুরে, নিজের ছয়তলা আলিশান বাড়িতে। সালমা ও মনি হাওলাদারও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বা কর্মচারী নয়। তবে তাদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম, অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে 'বয়স্ক ভাতা' কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। প্রাথমিকভাবে দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচজন পুরুষ, পাঁচজন নারীসহ ১০ জন দরিদ্র বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হতো। পরে দেশের সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ভাতার টাকাও বাড়ানো হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ লাখ বয়স্ক ব্যক্তির জন্য জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা বরাদ্দ করা হয়। প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া শুরু হয় ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে। তখন জনপ্রতি দেওয়া হতো ২০০ টাকা। পর্যায়ক্রমে তা বেড়ে হয়েছে মাসে ৭০০ টাকা। ভাতাভোগীর নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে লাগে মাত্র ১০ টাকা। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে বয়স্ক ভাতা পরিশোধের একটি বইও দেওয়া হয় ভাতাভোগীকে।
ভাতা পরিশোধের বই এবং ব্যাংকের চেকের পাতা ভাতাভোগীর কাছে থাকার কথা। কিন্তু কড়াইল এলাকার ৯০ শতাংশ ভাতাভোগীর বই তাদের কাছে দেওয়া হয়নি। পৃথকভাবে সেগুলো আটকে রেখেছে শাহনাজ, সালমা ও মনি হাওলাদার। ভাতাভোগীর কিস্তি পরিশোধের দিন সংশ্লিষ্ট সোনালী ব্যাংক শাখায় তারা ওই বই ও চেকের পাতা নিয়ে যায়। ভাতাভোগীরা সেখানে হাজির হন খালি হাতে। বয়স্ক ভাতা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হিসেবে তিন মাসে এক কিস্তিতে তোলা হয় ১৫০০ টাকা। এর মধ্যে ২০০ টাকা রেখে ভাতাভোগীকে দেওয়া হয় ১৩০০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও ১০০ টাকা কেটে রাখে তারা। কমিশন না দিলে বয়স্ক ভাতার তালিকা থেকে ভাতাভোগীর নাম বাদ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। কড়াইলের বেলতলা বস্তির জিয়াউর রহমান জানান, তার মা জমিলা খাতুনকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আসতে ছয় হাজার টাকা দিতে হয়েছিল শাহনাজকে। কয়েক বছর এ ভাতা নিয়মিতই পেতেন। তবে প্রায় এক বছর ধরে তিনি আর ভাতা পাচ্ছেন না। শাহনাজ শুরু থেকেই আটকে রেখেছে ভাতা প্রদানের বই।
রুমী আক্তার জানান, প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আসতে শাহনাজকে দিতে হয়েছিল তিন হাজার টাকা। কিছুদিন টাকা পেলেও আড়াই বছর ধরে তিনি কোনো টাকা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, 'তিন মাস পর গুলশানে কিস্তি দেওয়ার সময় যেতে হয়। কিন্তু শাহনাজ টাকা দেয় না, বইটিও দেয় না। বই করার সময় শাহনাজ তিন হাজার টাকা নিয়েছিল।' রুমী জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। বেলতলা বস্তিতে বসবাসকারী রুমী দুই বাড়িতে কাজ করার সময় সকালে ও দুপুরে সেখানেই খান। রাতে বাসায় মুড়ি খেয়ে থাকতে হয় তাকে। কারণ বাসা ভাড়া দেওয়ার পর অবশিষ্ট ৯০০ টাকায় জীবন যাপনের সব কিছুই করতে হয় তাকে।
বেলতলা বস্তির হনুফা বেগমের পুত্রবধূ রিনা আক্তার জানান, সাধারণত তিন মাস পরপর তার শাশুড়ি ১৩০০ টাকা বয়স্ক ভাতা পান। তিন মাসে ১৫০০ টাকা ব্যাংক থেকে তোলার পর শাহনাজ তা থেকে ২০০ টাকা নেয়। ভাতা বইটিও সে রেখে দিয়েছে।
বেলতলা বস্তির ভিক্ষুক সুরুজ আলী জানান, ভাতাভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হয়েও তিনি প্রায় পাঁচ বছর আগে জাকির হোসেন নামে বয়স্ক ভাতার টাকা তুলতেন গুলশানের সোনালী ব্যাংক থেকে। তখন মাসে ভাতার হার ছিল ৩০০ টাকা। জাকির হোসেন মারা যাওয়ায় তার নামে সুরুজকে দিয়ে ভাতা ওঠাত শাহনাজ। এই টাকা শাহনাজ ও সুরুজ ভাগাভাগি করে নিত। তবে ২১ মাস টাকা না পেয়ে পরে সুরুজ নিজেই মনি হাওলাদারের মাধ্যমে ভাতার আওতায় এসেছেন। সুরুজ আলীর স্ত্রী মহুরা খাতুন জানান, তার ভাতার বই মনি হাওলাদারের কাছে রয়েছে। সে প্রতি কিস্তিতে ১০০ টাকা কেটে নেয়।
একই বস্তির ভিক্ষুক জাহানারা বলেন, 'দেড় হাজার টাকা নিয়ে বই করে দিয়েছে শাহনাজ। বই তার কাছেই থাকে। কিস্তির সময় ব্যাংকে যেতে বলে। ১৫০০ টাকার মধ্যে ২০০ টাকা কেটে নেয়।'
কড়াইল বস্তি এলাকা শহর সমাজসেবা কার্যক্রম-৪-এর আওতাধীন। এর কার্যালয় খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায়। ১৩ মার্চ সেখানে গিয়ে কথা হয় শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা শাহিনা আক্তার সুইটির সঙ্গে। রুমী আক্তার ও জমিলা খাতুন ভাতাভোগীর তালিকায় আছেন কি না, জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। তালিকা ঘেঁটে তিনি জানান, তাদের বরাদ্দের কিস্তি গুলশানের সোনালী ব্যাংকের শাখায় জমা হয়। তাদের তা নিয়মিতই পাওয়ার কথা।
ভাতাভোগীদের কিস্তির পুরো টাকা আত্মসাৎ এবং কমিশন নেওয়ার তথ্য জানালে শহর সমাজসেবার এই কর্মকর্তা কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন কাছে। কর্মকর্তা সুইটি জানান, কিস্তি পরিশোধের দিন সঙশ্লিষ্ট সোনালী ব্যাংকে তার অফিসের তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী থাকেন। ভাতাভোগীর টাকা ওঠাতে ব্যাংকে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তা দেখাই তার কাজ। তাদের কাছ থেকে তিনি এ ধরনের কোনো সমস্যার কথা শোনেননি। ভাতাভোগীর কাছে বই না থাকার বিষয়টি তিনি জানেন না বলেও দাবি করেন। এসব তথ্য তার জানা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, 'অসহায় মানুষ যাতে এ ধরনের ঘটনার শিকার না হন, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
অনুসন্ধানে জানা যায়, শাহনাজ বাস করে গুলশান থানার কালাচাঁদপুরে নিজের আলিশান বাড়িতে (নম্বর ক-৫০, ৮/সি)। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা শাহনাজ বললে তাকে ওই এলাকায় এক নামে চেনে সবাই। ২০১২ সালে একটি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে সে বাড়ির কাজ শুরু করেছিল। তবে মাঝপথে ডেভেলপার কোম্পানি সরে পড়ে। তখন জমির মালিক হিসেবে পাওয়া পাঁচটি ফ্ল্যাট সে নিজেই সম্পন্ন করেছে। পাঁচটি ফ্ল্যাটের মধ্যে দুটি দুই ছেলে মিজু আহমেদ ও মিনারেল আহমেদের নামে, একটি স্বামী মোহাম্মদ আলী সরকারের নামে ও বাকি দুটি শাহনাজের নিজের নামে। দুই ছেলে অবশ্য দোতলায় তার সঙ্গেই থাকে।
শাহনাজ জানায়, 'প্রতিবন্ধীদের জন্ম নিবন্ধন করতে সরকারি ফি লাগে। এ ছাড়া অফিসে যাওয়া-আসার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়াও লাগে। কিন্তু এসব ওরা বোঝে না, ওরা মনে করে, শাহনাজ টাকা খায়।' বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা বাবদ টাকা নেয় না বলে দাবি করে সে। ভাতা পরিশোধের বই আটকে রাখার বিষয়ে সে জানায়, তার কাছে কোনো বই নেই। তবে ভাতা
দেওয়ার সময় সে ওদের বইগুলো নিয়ে লিখে দিয়ে সহযোগিতা করে। প্রতি কিস্তিতে জনপ্রতি ২০০ টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে সে বলে, 'আল্লাহ মাফ করুক। এ ধরনের কাজ করি না। তবে যারা বই লিখে দেয়, তারা দুই ২০ টাকা নেয়।'
আপনার মতামত লিখুন :