কায়কোবাদ মিলন : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আফসান চৌধুরী ১৪ মার্চ ভারতীয় সাউথ এশিয়া মনিটরের অনলাইনে ‘বাংলাদেশ একটি অনলাইন রাষ্ট্র’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তার অংশবিশেষ এখানে পত্রস্থ হলো।
বাংলাদেশ একটি অনলাইন রাষ্ট্র এবং এখানে ভার্চুয়াল নাগরিকের সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকম বেশি। ইন্টারনেটে অনেক মহান ব্যাপার ঘটে, আবার নোংরামিও কম হয় না। অনলাইন কনটেন্টকে ‘ক্ষতিকর’ আখ্যা দিয়ে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মাত্রা সম্প্রতি বেড়ে গেছে। কয়েকটি পর্ন সাইট যেগুলোর সবগুলোই বিদেশী সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউটিউবের ক্ষেত্রেও দুটো সাম্প্রতিক ঘটনা ঘটেছে যেখানে দুজন ইউটিউবারকে তাদের আপলোড করা কনটেন্ট সরিয়ে নিতে হয়েছে যেগুলোকে ‘অসম্পূর্ণ আখ্যা দেয়া হয়েছে এবং তাদেরকে এ জন্য ক্ষমাও চাইতে হয়েছে। এই প্রচেষ্টার পেছনে রয়েছেন স্বয়ং আইসিটি মন্ত্রী নিজেই, যিনি যৌনতা-সংশ্লিষ্ট কনটেন্ট বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী।
যে দেশে জিহাদী তৎপরতা দেখা গেছে, সে দেশে সাইবার সিকিউরিটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে হোলি আর্টিজানে যে হামলা হয়েছিলো, সেটা পুরো বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলো এবং অনলাইন দুনিয়া জিহাদী কাজে তরুণদের অন্তভূক্ত করার একটা সুবিধাজনক স্থান, যেহেতু এখানে তরুণদের উপস্থিতি ব্যাপক। তবে, হামলার পর থেকে সরকারের সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানগুলো যথেষ্ট সফল হয়েছে। এই সাফল্যের একটা বড় কারণ হলো অনলাইনে কড়া নজরদারি এবং পুলিশ কর্তৃক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। তাছাড়া কতগুলো বিষয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে আছে এবং এগুলোর ব্যত্যয় হলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার, সশস্ত্র বাহিনী এবং জাতীয় আইকন ইত্যাদি। কেউ যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে শুধু মজাও করে, আপত্তিকর মন্তব্য ও ব্যঙ্গ করার কথা বাদই দেন, তাহলে তাদেরকে গ্রেফতার করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের (ডিএসএ) অধীনে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। আরও বহু মানুষ যারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সমালোচনা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ডিএসএ লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তাদেরকে আটক করা হচ্ছে। সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মীরা এই আইনের প্রতিবাদ করলেও, আইন জায়গা মতোই রয়ে গেছে। যদিও আইনটি আগের চেয়ে এখন সামান্য কম ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু ১৯ ফেব্রæয়ারি বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করা হয়েছে এবং একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এই টিমটি এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। ক্ষমতাসীন দলের এক কর্মী এই মামলাটি দায়ের করেছেন।
ডিজিটাল দুনিয়া এককেন্দ্রিক নয় এবং সেখানে শুধুই রাজনীতি চলছে, এমনও নয়। কিছু ব্যক্তি আন্ডারগ্রাউন্ড মিডিয়া স্টার হয়ে উঠেছে এবং যেহেতু তারা নিষিদ্ধ বিষয়ের উপর আক্রমণ করে, তাই তাদের বহু অনুসারীও জুটে গেছে। এক সময় মালয়েশিয়া ভিত্তিক ইউটিউবার আসাদ পং পং খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু তার বক্তব্যের কারণে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে এবং তাকে এজন্য কারাগারেও যেতে হয়। এর পর থেকেই চুপ হয়ে গেছে সে।
শীর্ষ অবস্থানে এখন আছেন সেফুদা। মধ্য বয়স পার হয়ে যাওয়া এই ব্যক্তির অনলাইন অনুসারীর সংখ্যা এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। ইউরোপের কোথাও বাস করছেন তিনি এবং তাই সেখানকার আইনের সুরক্ষা রয়েছে তার। যে কোন ব্যক্তি বা যে কোন বিষয়ে তিনি আপত্তিকর ভাষায় আক্রমণ করেন। তার কোন ট্যাবু নেই এবং প্রকাশ্যেই তিনি বলেন যে তিনি মদ্যপান করেন এবং যেখানে সেখানে যাতায়াত করেন। তার দর্শক যাদের বেশির ভাগই তরুণ তাদেরকে তিনি তার নিজের মতো হওয়ার জন্য উসকানি দেন। তার জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে গেছে যে, অনেকে তার লেখা মনে করে কিছু বইয়ের অর্ডার দিয়েছে, যদিও তিনি এখন কোন বই লেখেননি। সন্দেহ নেই যে, তিনি একজন ডিজিটাল সুপারস্টার।
তিনি অবশ্য প্রায়ই আপত্তিকর এবং ঘৃণামূলক কথাবার্তাও বলে থাকেন। কিন্তু তিনি তার দর্শকদের খুশি রাখেন এবং তিনি যে স্বাধীনতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রতিনিধিত্ব করেন, সেটাকে তারা ভক্তি করে। সামাজিক বিবর্তনের এটা একটা সাংস্কৃতিক বহিপ্রকাশ।
সম্প্রতি অনলাইন সাংবাদিকতায় আরেকটি ঘটনা ঝড় তুলেছিলো। সেটা হলো চট্টগ্রামের একজন ডাক্তার আকাশের আত্মহত্যা নিয়ে। স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িত অভিযোগ করার পর আত্মহত্যা করে সে। আত্মহত্যা করার আগে সে নিজের ফেসবুক পেজে অন্যদের সাথে তার স্ত্রীর তোলা কিছু ছবি আপলোড করে, যেগুলো ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়ে পড়ে। আকাশ একইসাথে একটি ভিডিও-ও আপলোড করেছে যেখানে তার স্ত্রী মিতু বিবাহ বহির্ভূত বিভিন্ন সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে যে, সে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এবং ক্যামেরায় চরম আতঙ্ক নিয়ে কথা বলেছে সে।
সমাজের এই প্রতিক্রিয়াটা প্রত্যাশিতই ছিলো, বিশেষ করে যে সমাজে তরুণরা উচ্চমাত্রার উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মিতুর বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা হয়েছে, তার মধ্যে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এত জ্যান্ত হয়ে থাকার কারণ হলো ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও এবং ইউটিউবে এ সংক্রান্ত ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া।
তার কথিত ‘স্বীকারোক্তি’র খবরগুলোও বারবার করে ফিরে আসছে। মজার বিষয় হলো অধিকাংশ নিউজই নি¤œমানের, যার অর্থ হলো এগুলো অপেশাদার মানুষ আর্থিক লাভের জন্য তৈরি করছে। এভাবেই, ভাইরাল অর্থনীতির উত্থান হচ্ছে, এবং প্রতিদিনই শত শত মানুষ এই সেক্টরের দিকে ঝঁপিয়ে পড়ছে।
যেহেতু রাজনৈতিক মত প্রকাশের জায়গাটা সীমিত হয়ে গেছে এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়ের পর রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে, তাই ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ এবং অন্যের অনুকরণের মাধ্যমে মনোভাব প্রকাশের দিকে মনোযোগ ঝুঁকেছে মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই। সে কারণেই, বিভিন্ন ইস্যুতে সিরিয়াস ধরনের মতামতের চেয়ে রম্য রচনা বরং অনেক দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে।
এরকম একটি সাইট হলো ইয়ার্কি.কম যেটা তরুনরা চালালেও সব বয়সের মানুষদের কাছে এর আকর্ষণ রয়েছে। সাইটটির শেয়ারের সংখ্যা বহু হাজার হয়ে গেছে এবং স্বেচ্ছাসেবক কন্ট্রিবিউটররা এখানে বিপুল পরিমাণে লিখছেন। এটা একটা নতুন জিনিস যেটা দিয়ে সব ধরনের কাজ চলছে।
কিন্তু ডিজিটাল জগতের অগ্রযাত্রা চলবে এবং কেউই এর প্রবৃদ্ধি রুখতে পারবে না, তা যার কাছে যত অস্বস্তিকরই মনে হোক না কেন।
আপনার মতামত লিখুন :