সাদিয়া নাসরিন : নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের মেরুকরণ স্পষ্টতই ভিন্ন এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বও পরিষ্কার। এই দ্বন্দ্ব একারণে নয় যে, আমি নারী আপনি পুরুষ। বরং এর পেছনের কারণটি হলো নারী-পুরুষের সামাজিক শ্রমবিভাজন ও তার হাত ধরে তৈরি হওয়া ভিন্ন ভিন্ন অধিকার, চাহিদা ও বৈষম্য। নারীবাদ সম্পর্কের সেই মেরুকরণের নতুন নির্মাণ চায়। এখন পুরুষ যেহেতু সেই মেরুকরণের প্রাথমিক সুবিধাভোগী, তাই তারা এই দ্বন্দ্ব টিকিয়ে রাখতে চান। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকা পুরুষ তাই রাজনীতি বোঝেন, অর্থনীতি বোঝেন, পুঁজিবাদ বোঝেন, সমাজতন্ত্র বোঝেন, অথচ নারী-পুরুষের সমঅধিকারের মতো স্বাভাবিক একটা বিষয়ে কথা বললেই অহেতুক বিতর্ক তৈরি করেন। সেই বিতর্ককে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক প্রচার মাধ্যমে, শিক্ষা ও গবেষণায় নারীবাদ নিয়ে এমন উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে রাখে যে, নারীবাদ বলতে কেবল পুরুষ বিদ্বেষ, শ্রেণি বৈষম্য, পশ্চিমা তত্ত্ব আর এনজিও-জার্গাম খুঁজে পান। কিন্তু সময় এসেছে সব সংশয় দূর করে এসব উদ্দেশ্যমূলক বিতর্ক না বাড়িয়ে নারী-পুরুষ উভয়েরই পুরুষতন্ত্রের এঁকে দেয়া গ-ি পেরিয়ে নারীবাদকে পরিষ্কার করে বোঝার। নারীবাদ একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম যা ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সকল নারীকে এবং পুরুষকেও পুরুষতন্ত্রের নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করে।
নারীবাদ মানে কোনোভাবেই পুরুষ বিদ্বেষ নয়, এক্সট্রিমিস্ট নয়, ডিভোর্স নয়, ফ্রি সেক্স নয়, মাতৃত্ববিরোধী নয়, পরিবার, সমাজ বিলুপ্ত করার বিপ্লবও নয়। আবার নারীবাদ মানে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণও নয়। নারীবাদ মানে প্রশ্ন তোলা, অবিরাম প্রশ্ন তোলা এবং পুরুষতন্ত্রের জমিনকে পোক্ত করে এমন সব বৈষম্যমূলক নিয়ম- কানুন-আচার-প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করা। সন্তান জন্মদানের মতো একটি স্বাভাবিক ও জৈবিক প্রক্রিয়াকে পুঁজি করে নারীদের গর্ভ ও গর্ভজাত সন্তানকে অধিকার করার জন্য যুগ যুগ ধরে নারীর ওপর যে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্য চলছে তার প্রতিবাদই নারীবাদ।
এটি এমন এক রোমাঞ্চকর চর্চা যা আমাদের মনের অস্পষ্ট ধারণাগুলোকে ভাবায়, নিজেকে চিনতে, খনন করতে শেখায়, নতুন করে নির্মাণ করে। নারীবাদ নির্মাণ ও নির্বাণের এক জীবনব্যাপী শিক্ষা, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলোকে, একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাসগুলোকে পূণর্মূল্যায়ন করে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরবির্তন করতে শিখি। নারীবাদ সৃষ্টি করেছে নির্বাণের এক নতুন বোধ, যা আমাদের একপেশে আপসের দায়ভার থেকে, সম্মানহীন-অধিকারবিহীন সম্পর্ক থেকে মুক্ত হওয়ার শক্তি ও সাহস দিয়েছে, নিয়তির বিশ্বাস থেকে মুক্ত করেছে।
নারীবাদ আমাদের মধ্যে তৈরি করেছে সেই মূল্যবোধ, যার কারণে আমরা মুক্তি পেয়েছি নিরন্তর অপরাধবোধ থেকে, হীনমন্যতা থেকে, যার কারণে আমাদের প্রতি ঘটা সব অন্যায়-নির্যাতন এর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করতাম। এই তত্ত্ব নির্মাণ করেছে আমাদের এমন সব নতুন চিন্তা ও চেতনা যার কারণে আমরা বুঝতে পেরেছি আমাদের জীবনে পুরুষতান্ত্রিকতাকে সবার আগে মূর্ত করে আমাদের একান্ত স্বজনরাই। পুরুষাধিপত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে তাই অনিবার্যভাবেই সবার আগে নিজেদের বাবা-ভাই-বন্ধু-স্বামী-পুত্রদের সঙ্গে বিবাদে জড়াতে হয়, বিচ্ছিন্ন হতে হয়। এই উপলদ্ধি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, বেশিরভাগ সংসারের ‘শান্তিপূর্ণতা’ হচ্ছে সামনের ছবি, যার পেছনে নারীর স্বপ্ন, অনুভূতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আবেগ এবং যোগ্যতার ভাঙা টুকরো ছড়ানো। এটি এমন এক রাজনৈতিক সংগ্রাম যা আমাদের সাথে সেসব নারীদের আত্মিক বন্ধন তৈরি করেছে যারা আমাদের আনন্দ-বেদনার সহযাত্রী, যারা আমাদের বলা এবং না বলা কথা অনুভব করতে পারে, একসাথে কাঁদতে পারে অথবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পারে। এটি এমন এক আত্মিক যোগাযোগের নাম, যা আমার পূর্বনারীদের আত্মত্যাগ, আর্তচিৎকার আর বলিদানকে বোঝার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সকল নিপীড়িত নারীর সাথে একাত্ম করেছে। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :