বিভুরঞ্জন সরকার : একাত্তরের পহেলা মার্চ। যদ্দূর মনে পড়ে দিনটি ছিলো শুক্রবার। তখন আমি দিনাজপুর সরকারি কলেজের ছাত্র। আগের দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত প্যানেল হেরে যায়। স্বভাবতই মন খারাপ। পরের দিন সকালে হোস্টেল থেকে বের হলাম। কিন্তু কলেজে না গিয়ে ঢুকলাম ‘চৌরঙ্গী’ হলে, মর্নিং শো দেখতে। ‘রোড টু সোয়াত’ নামের একটি উর্দু সিনেমা চলছিলো। বেলা একটার কিছু পরে সিনেমা শেষে রাস্তায় নেমে দেখি মিছিলে স্লোগানে উত্তাল চারদিক। কি ব্যাপার? হঠাৎ মিছিল কিসের, কেনো?
প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো পরিচিত কাউকে না পেয়ে মিছিলে সামিল হলাম। মিছিলে শুনি নতুন স্লোগান। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ইয়াহিয়ার মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ভুট্টোর মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। বুঝলাম, মারাত্মক কিছু ঘটেছে। তবে কি ঘটেছে সেটা জানার জন্য আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। মিছিল সামনে অগ্রসর হচ্ছে আর তাতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। কাউকে ডাকতে হচ্ছে না। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিচ্ছেন। এ রকম ঘটনা আগেও দেখিনি, পরেও না।
মিছিল গিয়ে জমায়েত হলো দিনাজপুর ইন্সটিটিউটের সামনের খোলা মাঠে। সেখানে গিয়ে জানলাম মিছিলের কারণ। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নব নির্বাচিত সদস্য (এমএনএ) মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। তিনি তখন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক আকস্মিক বেতার ভাষণের মাধ্যমে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এটা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালির স্বার্থবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে যে ক্ষমতা দিতে চায় না তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইয়াহিয়ার এই ঘোষণায়।
ইয়াহিয়ার ঘোষণার পরপরই বিক্ষুব্ধ বাঙালি রাজপথে নেমে আসে। আগে স্লোগান ছিলো ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, এর সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন স্লোগান স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্দেশ দেয়ার আগেই, ইয়াহিয়ার বেতারভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি রাস্তায় নেমে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। অস্ত্র হাতে নেয়ার স্লোগান দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন করার কথা বলেছে।
কি আশ্চর্য ঘটনা! কি করে মানুষ কোনো নেতার নির্দেশ ছাড়াই এভাবে পথে নামলো? এই ঘটনা কেবল ঢাকায় ঘটেনি, ঘটেছিলো সারাদেশের শহরে-বন্দরে-গ্রামে, এক যোগে। পাকিস্তানিদের মতলব ভালো না এটা বুঝতে সেদিন কারো অসুবিধা হয়নি। বাঙালি স্বাধীনতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিলো। তার প্রমাণ পহেলা মার্চের বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশ এবং জনতার স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান।
সেদিনই এটা স্পষ্ট হয়েছিলো যে পাকিস্তানের কবরে অভ্যুদয় ঘটতে চলেছে এক স্বাধীন ভূখন্ডের, নাম তার বাংলাদেশ। জ¦লে পুড়ে ছাড়খার তবু মাথা নোয়াবার নয়।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
মার্চ মাসের প্রথম দিন যা ছিলো জনতার কণ্ঠে স্লোগান, ডিসেম্বরের ষোলো তারিখে তাই বাস্তবে রূপ পেলো। বাংলাদেশ হলো শত্রুমুক্ত। ভেতো বাঙালি প্রয়োজনের সময় ঠিকই অস্ত্র ধরলো। লড়লো। মরলো। মরার দেশে বরাভয় আনলো এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করলো ।
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :