আফসান চৌধুরী
আমার জন্ম ঢাকায় এবং এখানেই বেড়ে ওঠা। তারপরও এই শহর সম্পর্কে আমি খুবই কম জানি। খারাপ ডিজাইনের এক ভাড়া বাসায় আমি থাকি। এই ভবনগুলো ৮-১০ তলা, এখানে যারা থাকে তাদের গাড়ি আছে এবং তারা কারণ ছাড়াই দ্রুতগতিতে গাড়ি চালায়। আবাসিক এই এলাকার নাম নিকেতন, যেখানে সমাজের উচ্চ শ্রেণির লোকেরাই বাড়ি বানায়।
শহরের এই অংশ থেকে বেশ খানিকটা দূরে আফতাবনগর। এখনো এর শ্রেণি পরিচয় নির্ধারণ হয়নি। কিন্তু এলাকাটি আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত। আমি নিজেই ঢাকায় এক অপিরিচিত ব্যক্তির মতো বাস করি। ওই দিন আমি সেখানে এক নারীর খোঁজে গিয়েছিলাম, যে নিজেও এই ঢাকায় খুব কমই পরিচিত। সে খুবই সাধারণ একজন মানুষ। মাত্র ষোলো বছর বয়সে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নিজের বাড়ি ছেড়ে বন্দুকহাতে যুদ্ধে গিয়েছিলো সে। সম্ভবত ডজনখানেক নারী এই যুদ্ধে গিয়েছিলো, তাদের মধ্যে সেও ছিলো একজন। এই এলাকার বাড়িগুলো অতোটা সুন্দর নয়, দ্রুত বেড়ে ওঠা নগরায়নের চাহিদা মেটাতে মনে হয় একটু তাড়াহুড়া করেই তৈরি হয়েছে। বেশ কয়েকটা ফোন করার পর তার থাকার জায়গাটি খুঁজে বের করতে পেরেছি। আমার সঙ্গে আরও দু’জন ছিলো। তারা ক্যামেরা ক্রু, দেশের অনিশ্চিত মিডিয়া জগতের শিকার, বেকারত্বের মধ্যে থেকে এখন চাকরি খুঁজছেন। সরু গলি দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলাম আমরা। একসময় সেই বাসাটিতে গিয়ে হাজির হলাম। তার মেয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। তার এক আত্মীয়ের বাড়ি সেটা। একটা শিশু খেলছিলো, সোফায় দেখলাম বাদামি রঙের বড় একটা পান্ডা পুতুল। আর তখনই সে এলো। যে মানুষটিকে আমি তারুণ্যে চিনতাম, সে এখন ষাটোর্ধ। সময় আর অসুস্থতা অনেক কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। মেয়েটি বললো, ‘ওনার শরীর অনেক খারাপ ছিলো, এখন অনেকটাই ভালো।’ এই বলে সে তার মোবাইলে তোলা কয়েকটা ছবি দেখালো। দেখলাম অসুস্থ শীর্ণ একটা দেহ, যেন মৃত্যুর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না, আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আমি তার ইতিহাস জানি, জানি তার ভয়ংকর সংগ্রামের কথাও। সেইসঙ্গে এ কথাও জানি- তার এই ইতিহাস ও সংগ্রাম- কোনোটির প্রতিই পর্যাপ্ত সম্মান দেখানোর ক্ষমতা আমার নেই।
ক্যামেরা চলতে শুরু করলো। সে ১৯৭১ এ ফিরে গেলো। তার সেই প্রতিজ্ঞা, সাহস, ভয় আর বিসর্জনের কথা বলতে লাগলো। আমি দেখলাম- দুই দশক আগে তার সঙ্গে যখন কথা বলেছিলাম, তার চেয়েও অনেক পরিপক্ক হয়েছে তার কথাবার্তা। সে এখন অনেক বেশি শান্ত, কম রাগী, কম ক্ষিপ্ত। সে শব্দগুলো নির্বাচন করছিলো সতর্কভাবে। সন্তানদের জন্য তাকে কীভাবে টিকে থাকতে হয়েছে, সেই কথা বলছিলো। কোনো রকম বাধা না দিয়ে আমি শুনে যাচ্ছিলাম। একসময় বিদায় নেয়ার সময় এলো। ভদ্রসূচক পানীয় হিসেবে চা খেলাম। আসলে তার সম্পর্কে আমার নতুন কিছু জানার ছিলো না, তার সবই আমি জানি। তারপরও তার আশা-ফ্রিডম ফাইটারদের তালিকায় যেন তার নামটি ওঠে। কিন্তু আমি তো জানি, অনেক সময়ই সঠিক বিষয়টা ঘটে না। আমি তাকে কোনো আশার বাণী শোনালাম না, কোনো হতাশার কথাও বললাম না। দেখা যাক কী হয়। কারণ আমি তো এটাও জানি সাধু আর শয়তান- উভয়েই পাশাপাশি বাস করে।
আমরা যখন বিদায় নিবো, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী সম্মান দেখাতে গিয়ে সে নিচু হলো এবং আমার পা স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। আমি থামালাম। বললাম, ‘তার চেয়ে আমার মাথা স্পর্শ করে আশীর্বাদ করো। মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সেনানী ভুল জায়গায় সম্মান জানাবে- এটা হয় না। গলি থেকে বের হয়ে আমরা প্রধান সড়কে এলাম, তারপর হাতিরঝিলের সেই ব্যস্ত রাস্তায়। ফিরতে শুরু করলাম আমাদের পরিচয়হীন আবাসের দিকে।
লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আপনার মতামত লিখুন :