আশিক রহমান : একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি অসীম সাহা বলেছেন, পুরস্কার একধরনের স্বীকৃতি। তবে আমলাতন্ত্রের কারণে অনেক সময় এই স্বীকৃতিতে স্বচ্ছতা থাকে না! কারণ দেশের আমলাতন্ত্র এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, তাদের চাপে পড়ে শুধু পুরস্কারই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই পদায়ন, যোগ্যদের যোগ্যস্থানে স্থাপনের কাজটিও হয় না। এ প্রতিবেদককে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে অনেক যোগ্য লোক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা পুরস্কার থেকে বঞ্চিত থাকেন।
২০১৯ সালে একসঙ্গে যে একুশজনকে একুশে পদক দেয়া হলো। এমন হলে আগামী ২০ বছরে কতো পুরস্কার দেয়ার জন্য কতো লোকের দরকার হবে, তা কি কর্তৃপক্ষ একবারও ভেবে দেখেছেন? এরপর তো পুরস্কার দেয়ার জন্য যোগ্য লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে না! একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি অসীম সাহা বলেছেন, প্রতি বছর একুশজন করে পুরস্কার দেয়া অব্যাহত থাকলে ২০ বছর পর পুরস্কারের জন্য যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ-প্রতিবেদককে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একুশে পদকপ্রাপ্তিতে আমি উল্লসিত বা আনন্দিত নই। কারণ যে বয়সে এই পুরস্কার পেলে আনন্দিত বা উল্লসিত হওয়া যায়, সে বয়স আমি অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি। প্রশ্ন উঠতে পারে, পুরস্কারের কি কোনো বয়স আছে? আমি মনে করি আছে। কেননা এখন আমার জীবন অস্তাচলের পথে। মৃত্যুর আগে এই পুরস্কার হয়তো কিছুটা বেঁচে থাকার জীবনীশক্তি দিতে পারে। কিছুদিন হয়তো মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে পারে। আবারও প্রশ্ন আসতে পারে, আমি কি আরও আগে মরতে পারতাম না? হ্যাঁ, তখনো মরতে পারতাম। কারণ মৃত্যু কাউকে বলে-কয়ে আসে না। আমার বয়স এখন সত্তর। ২০১১ সালে আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছি, উনিশে পেলাম একুশে পদক। আট বছরের ব্যবধানে এ-দুটি পুরস্কার আমি পেলাম! ১৯৬৪ সাল থেকে আমি লিখি। সময়ের হিসেবে অনেক দীর্ঘ একটা পথ। আমি তো আরও আগেই পুরস্কার পেতে পারতাম, এতোদিন লাগলো কেন আমাকে বা আমাদেরকে পুরস্কৃত করতে?
এক প্রশ্নের জবাবে অসীম সাহা বলেন, এবার ভাষা ও সাহিত্যে ছয়জনকে একসঙ্গে পুরস্কার দেয়া হলো, এটাকে ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে করি না আমি। যদিও কবিতায় একমাত্র আমিই পদক পেয়েছি, তবু এর পেছনে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার ঘাটতি আছে বলে মনে করি। আমার পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে আগে আমলাতান্ত্রিক বাধা ছিলো বলে আমি শুনেছি। সেটা কতোটা সত্য তা আমি জানি না। আমলাতান্ত্রিক বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরস্কার পেয়েছি, এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমার সহপাঠী। তাঁর হাত থেকে আমি একুশে পদক নেবো, এটা আমার জন্য খুব আনন্দের। পুরস্কার বা পদকপ্রাপ্তি আমাকে যতো আনন্দ দিয়েছে, তারচেয়ে আমি বেশি আনন্দিত হবো, জাতির জনকের কন্যার আমার হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন বলে।
তিনি বলেন, প্রশাসন থেকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনো দূর না হওয়ার কারণ হচ্ছে, আমলাদের পরিচালনার জন্য রাজনীতিতে যে যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ দরকার, সে-ধরনের মানুষ আমাদের খুব বেশি নেই। ডাকসাইটে, শক্ত, মজবুত ও প্রশাসন বোঝেন, এমন কেউ যদি মাথার ওপরে থাকেন তাহলে আমলারা জটিলতা তৈরি করতে সাহস পান না। দুর্বল নেতৃত্ব আমলাদের সুযোগ করে দেয় প্রশাসনে নানান জটিলতা তৈরির। আমরা এমনও দেখছি, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও তা মানা হয় না। এ-ধরনের খবর তো প্রায় দেখি। এই দুঃসাহস তারা পায় কোত্থেকে? কিছু হলেই সকলে প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়ে দেন। তিনি ক’দিক দেখবেন? অনেকেই কবি নির্মলেন্দু গুণকে স্বাধীনতা পদক চেয়ে নিয়েছেন বলে তাঁর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাকে চেয়ে নিতে হলো কেন? সময়মতো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও আমলারা তার প্রাপ্য পুরস্কার তুলে দেননি কেন? প্রধানমন্ত্রী জানতেনই না নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীনতা পদক পাননি। শুনে প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত হয়েছিলেন। তার মানে নির্মলেন্দু গুণকে ষড়যন্ত্র করে পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। আমার ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে বলে মনে করি। আসলে প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করার জন্যেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ-ধরনের কাজ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সাধারণের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য লবিং তদ্বির চলে। কারণ অনেকেই মনে করেন যে, পুরস্কার পেলেই অনেক উচ্চতায় উঠে যাওয়া যায়। এটা সব সময় সত্য নয়। পৃথিবীতে এমনও অনেক বড় লেখক-কবি-সাহিত্যিক রয়েছেন যারা নোবেল পুরস্কার পাননি, কিন্তু তারা কোনো অংশেই ছোট নন। পুরস্কার একজনকে স্বীকৃতি দেয়। সেটা হতে পারে রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কিন্তু পুরস্কারই একমাত্র মাপকাঠি নয় একজন কবি বা লেখক কিংবা বিশেষ মানুষের গুণের মূল্যায়নে। কবি জসীম উদদ্ীন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি। কিন্তু তাতে কি জসীম উদ্দীন কবি হিসেবে গৌণ হয়ে গেছেন? আহমদ ছফাও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি, কিন্তু তাঁর মতো বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ কতোজন আছেন বাংলাদেশে?
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই কবি বলেন, এদেশে গুণীদের কদর করা হয় মৃত্যুর পরে। জীবিত থাকতে তাদের মূল্যায়ন হয় না! রুনা লায়লার মতো এতো বড় মাপের একজন শিল্পীর সঙ্গীত জীবনের পঞ্চাশ বছর নীরবে চলে গেছে। রাষ্ট্র কিংবা আমাদের সঙ্গীতজগতের মানুষেরাও তাকে নিয়ে কোনোকিছুরই আয়োজন করেননি। শিল্পকলা, বিটিভি কিংবা অন্য কোনো টেলিভিশন চ্যানেল বিস্ময়করভাবে তার ব্যাপারে নীরব ছিলো। অথচ পশ্চিম বাংলার টেলিভিশন চ্যানেল ‘জিটিভি’ একটা বিশাল আয়োজন করেছিলো। সেখানে আশা ভোঁসলে থেকে শুরু করে ভারতের অনেক সম্মানিত শিল্পী মানুষ দাঁড়িয়ে তাকে স্যালুট জানিয়েছে, সম্মান জানিয়েছে। এটা তো আমাদের জন্য অনেক বড় লজ্জার। এদেশে যে গুণীর কদর হয় না, এটা কি তার বড় প্রমাণ নয়? আমাদের ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বাহাদুর হোসেন খান, শচীনদেব বর্মন প্রমুখ এ দেশ থেকে চলে গেছেন। তালাত মাহমুদ এ দেশে থাকতে এসেছিলেন, আমরা তাকে রাখতে পারিনি। এটা সর্বক্ষেত্রে হচ্ছে। রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন গৌণদের প্রাধান্য।
তিনি বলেন, এই যে বইমেলা হচ্ছে। ১ মাসে চার-পাঁচ হাজার বই প্রকাশিত হবে। কিন্তু তা থেকে একশ ভালো বই বাছাই করে আলাদা করা যাবে না। শুধু মেলা হলেই তো হবে না, বই প্রকাশ হলেই তো হবে না, বই তো মানসম্পন্ন হতে হবে। ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি। বাংলা একাডেমির বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। কিন্তু আমি তো দেখছি, সেটা এখন আর প্রাণের মেলা নেই, পণ্যমেলায় পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ-দেশটির স্থপতি। জীবনভর তিনি নিজেকে মানুষের জন্যে কাজ করেছেন। একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। সেই মানুষটিকে আমরা খুন করলাম। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছে। আজকে দেশে যে এতো বিপত্তি, তা সেই উল্টোপথে যাত্রার ফল। উদাহরণ হিসেবে বলি, পাকিস্তানি আমলেও যোগ্যতা নিরিখ ছিলো। তাই কবি শামসুর রাহমানের আগেই আল মাহমুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। তখন যোগ্য লোককে যোগ্য মর্যাদা দেয়ার মানুষ ছিলো। তারা লেখক নন, লেখার গুণগত মান বিচার করতেন। এখন তার পরিবর্তন ঘটেছে। তাই পুরস্কার ও পদক অনেক সময় অপাত্রে দান করা হচ্ছে। এভাবেই চলছে। আমি আশা করি, মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন এই পুরস্কারের গুণগত মান আগের মতোই নিশ্চিত হবে এবং যথার্থ লোক যথাসময়ে নিজেদের মর্যাদা পাবেন।
আপনার মতামত লিখুন :