মানবর্দ্ধন পাল : জীবনানন্দীয় একটি আপ্তবাক্য অন্তত আমরা সবাই জানি : ‘সকলেই কবি নয়, কেউ-কেউ কবি। জীবনানন্দের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়ে তাঁর বাণীটি একটু পরিবর্তন করে বলা যায়, ‘সকল কবি নামধারীরাই কবি নয়, কেউ-কেউ প্রকৃত কবি।
অনির্দিষ্টতাবাচক এই ‘কেউ-কেউ’ সর্বনামটি দিয়ে আমরা কাদের বোঝবো? তাতে সংখ্যার স্বল্পতা অবশ্যই বোঝায় কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বা সবিশেষ কাউকে বোঝায় না! ষড়ঋতুর এই বঙ্গীয় পলল-ভূমিতে, এই নাতিশীতোষ্ণ জল-হাওয়ায় তথাকথিত কবি ও কবিতার জন্ম আগাছার মতো। আগাছায় চেনা যায় না ঔষধি কিংবা ফলবতী গাছ। এখন আগাছাকবিতে কবিতার কানন এমনভাবে ছেয়ে গেছে যে, জীবনের জন্য উপাদেয় কবিতার পুষ্টি পাওয়াই ভার। অখাদ্যে-কুখাদ্যে পরিপূর্ণ কবিতার বাজার।
তাছাড়া ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, অকবিরা দখল করতে চাইছে বইমেলা ও কবিতার বাজার। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সিজনাল অকবিরা প্রবাস থেকে এসে এক সঙ্গে পাঁচ/সাতটা বই বের করে ফেলছেন। তাদের ট্যাকের জোর এতো বেশি যে, সেই বই নামক ছাই-ভস্ম প্রচারের জন্য হাজার-হাজার চাররঙা সচিত্র লিফলেট-পোস্টারে প্রতিদিন সয়লাব করে দিচ্ছেন বইমেলা। নামিদামি পত্রিকায় রঙিন বিজ্ঞাপনও আসছে প্রতিদিন। মেলার মাঠে যাকে-তাকে ধরে সেই বই-বর্জ্যের মোড়ক উন্মোচন করে মিষ্টিমুখ করায় ওরা, অকাতরে মুড়ি-মুড়কির মতো বিলিয়ে দেয় সেই বই-বর্জ্য। অকবিদের উন্মাদনায় নামগোত্রহীন অসৎ প্রকাশকরাও মওকা পেয়ে যায়! ঐ উড়াল-অকবিদের দোহন করে যথেচ্ছভাবে।
বাংলাদেশের বই-বাজারে এখন এই অকবি-অলেখকদের অপসংস্কৃতির দাপটে প্রকৃত কবি-লেখকদের নির্ণয় করা ভার। ওরা ভঙ্গি দিয়ে ভোলাচ্ছে, প্রসাধন ও পার্লারের উৎকট সাজ দিয়ে টানছে। কেউ মনের ছোঁয়ায় পাঠকের অন্তরের দ্বার খুলতে পারছে না।
এমনি উদ্ভট পরিস্থিতিতে যে দু-চারজন কবি এদেশের কাব্যজগতে আলো ছড়াচ্ছেন, পাঠকের মনকে আলোকে উদ্ভাসিত করছেন, তাঁদের মধ্যে কবি অসীম সাহা অন্যতম। তাঁর অনন্যতা, তাঁর কবিচারিত্র্য ও কাব্য-বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই নিহিত। এ- লেখা অবশ্য কবি অসীম সাহার কবিতার বৈশিষ্ট্য মূল্যায়নের জন্য নয়। তবে রেখাচিত্রের মতো শুধু এটুকু বলা যায় যে, তিনি কেবল প্রেম-প্রকৃতি, দেশ-দয়িতা ও মানবতার কবি নন। কবি হিসেবে শিল্পের শর্ত পূরণ করেও আদর্শের পতাকাটি তিনি সর্বদা সুউচ্চে ধরে রাখেন। তাঁর এই আদর্শবাদিতার অন্যতম স্তম্ভ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানুষের সার্বিক মুক্তি। শিল্পের কলাকৈবল্যবাদিতা অর্থাৎ শিল্পের জন্য শিল্প, এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে কবি অসীম সাহা মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য শিল্পসৃষ্টির তত্ত্বেই বেশি আস্থাশীল। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা, হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঙালিয়ানা এবং সাম্যের দর্শন। এসবকিছুর সমন্বয়েই বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্র। কবি অসীম সাহার জীবনদর্শনের প্রাণভ্রমরটিও ওখানেই নিহিত। কবির এই আত্মদর্শনের সঙ্গে তিনি আপসহীন। তাই শিল্পচর্চায় এই দর্শনের ঝান্ডা উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন শক্ত হাতে। এজন্য সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চেতনা ধারণ করে একজন যতো বড় শিল্পসাধকই হোক, তিনি মনুষ্যত্ব ও মানবতা-বিরোধী। তিনি কবিত্বের অপচয় ও বর্জ্যের বিষবাষ্প ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না।
কবি অসীম সাহার শৈল্পিক স্বাতন্ত্র্য ও কাব্যবীজ তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, অসাম্প্রদায়িকতায়, বাঙালিত্বে এবং শোষিত শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির বীজতলায় প্রোথিত। আর এজন্যই তিনি এবার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। নিরাপস আদর্শবাদিতায় নিষ্ঠাবান কবি অসীম সাহার আজ শুভ জন্মদিন। এই ফুলফোটা মঞ্জরিত বসন্তে, লাল পলাশ-ফোটা ফাল্গুনে আর একুশের রক্তঝরা ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে কবির পৃথিবীতে পদার্পণ। শুভ জন্মদিন কবি অসীম সাহা। প্রেম, প্রকৃতি ও পরাভবহীন মানুষের মুক্তিচেতনার ধারক আপনার কবিতার জয় হোক, আপনি শতায়ু হোন। বারবার ফিরে আসুক আপনার শুভ জন্মদিন!
আপনার মতামত লিখুন :