অসীম সাহা : বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেছেন। ত্রিশের কবিতায় যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তী, তার প্রভাববলয়ের বাইরে বেরিয়ে আধুুনিক কবিতাকে নতুন করে নতুন অবয়বে নির্মাণ করার যে শক্তি, তা পঞ্চাশের দশকে এসে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়। ত্রিশের ধারাবাহিকতায় ত্রিশ এবং চল্লিশের অনেক কবি কবিতা লিখেছেন। কিন্তু সেখানে ত্রিশের কবিদেরই ব্যর্থ অনুকরণ বাংলা কবিতায় নতুন কোনো দিগন্ত তৈরি করতে পারেনি। পঞ্চাশের দশকে এসে কলকাতায়ও যেমন, তেমনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানেও যারা নতুন কবিতার দিগন্তাভিসারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আল মাহমুদ অন্যতম প্রধান। একদিকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, আলোক সরকার প্রমুখ; অন্যদিকে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ কবিতায় দ্বৈত নতুনত্বের অভিসারী হিশেবে নিজেদের স্থানটি স্থায়ী করে নিতে সক্ষম হন। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠেন আল মাহমুদ তাঁর লোকজ ঐতিহ্য ও আধুুনিকতার মেলবন্ধনের মাধ্যমে! এসব কবিতা একেবারে অচেনা, অজানা, আনকোড়া ও নতুন। ‘লোক-লোকান্তর’, ‘কালের কলস’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর তাঁকে নতুন কবি হিশেবে সময় যেমন আধুনিক কবিতার জগতে সাদরে আসনটি পেতে দিতে বাধ্য হয়, তেমনি ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর তিনি হয়ে ওঠেন ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’! তিনি যখন বলেন, “সোনার দিনার নেই/দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি।” কিংবা “গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল।” তখন বাংলা কবিতার পাঠক একটি চমকিত আবেগের ঘনীভূত রূপে বিস্ময়ে স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে যান। জীবনানন্দের পরে এমন ঘোরলাগা কবিতার পংক্তিমালা নির্মাণে আল মাহমুদ বাংলা কবিতার জগতে তাঁর আসনটি স্থায়ী করে নিতে সক্ষম হন।
কিন্তু ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হিশেবে কলকাতায় অবস্থানকালীন সমাজতন্ত্রী সিপিএম-এর সংস্পর্শে এসেই কিনা জানি না, আল মাহমুদের কবিতায় আদর্শগত বাক্বদল ঘটে। তিনি হয়ে ওঠেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী! জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর পত্রিকার দৈনিক গণকণ্ঠে সম্পাদক হিশেবে যোগদান করেন। তাঁর কলম থেকেও নিঃসৃত হতে থাকে সাম্যবাদের পক্ষে কবিতা। সে-সময় ১৯৭৩ সালে আমিও তাঁর সহকারী হিশেবে ঐ পত্রিকায় কাজ করতে শুরু করি। দৈনিক গণকণ্ঠ বঙ্গবন্ধুর নতুন সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। আল মাহমুদ জাসদের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতে শুরু করেন। পত্রিকাটি এতোই সরকারবিরোধী হয়ে ওঠে যে, সরকার গণকণ্ঠ পত্রিকা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। আল মাহমুদকে যেতে হয় কারাগারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যখন বিষয়টি জানতে পারেন, তখন আল মাহমুদ মুক্তি তো পানই, এমনকি যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে অফিসার পদে নিয়োগ পান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর সারাদেশ যখন শোকস্তব্ধ, তখন কবি নির্মলেন্দু গুণ জাতির পিতার খুনের প্রতিবাদে কবিতা লিখলেও আল মাহমুদ কবিতা লেখা তো দূরের কথা, তিনি গিয়ে জিয়াউর রহমানের বিএনপির কালচারাল উইং ‘জাসাসের’ সভাপতি হন। দীর্ঘদিন তিনি সেই পদে অধিষ্ঠিত থেকে শুধু ব্যক্তিস্বার্থের জন্য স্বাধীনতাবিরোধী জামাতের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের আদর্শ অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন। তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সুবিধা নিয়ে ঢাকা শহরে রাজকীয় জীবনযাপনও করতে থাকেন। এক আদর্শবাদী কবির উল্কাপতনের পর রূপান্তরিত হন সম্পূর্ণ মৌলবাদীতে। যে আল মাহমুদের সঙ্গে ছিলো আমার পারিবারিক সম্পর্ক, তাতে ফাটল ধরে। আল মাহমুদের স্ত্রী নাদিরা ভাবীর স্নেহধন্য আমরা আল মাহমুদের হয়ে যাই একেবারে পর।
আমরা তখন থাকি খিলগাঁও এলাকায় প্রায় পাশাপাশি। দুজনই বেকার। তবু প্রতিদিন বিকেলে মাহমুদ ভাই আমার বাসায় এসে চা পান করেন। এটা প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। মাঝেমধ্যে আমি আর কবি মাশুক চৌধুরী যাই মাহমুদ ভাইয়ের বাসায়। আল মাহমুদের স্ত্রী নাদিরা ভাবীর আন্তরিক আপ্যায়নে আমরা আপ্লুত হই। ভাবী খুব পর্দানসীন মহিলা ছিলেন। কিন্তু আমি আর মাশুকের সামনে তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ। কখনো আব্রুতে ঢেকে তিনি আমাদের সামনে আসতেন না। এতোটাই ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন আমাদের। কিছুদিন পর আমি খিলগাঁও এলাকা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চলে এলে আমাদের সঙ্গে তেমন আর দেখা-সাক্ষাৎ হতো না। মাহমুদ ভাই আদর্শগতভাবে দূরে চলে যাওয়ায় আমার পক্ষেও তাঁর কাছে আর যাওয়া সম্ভব ছিলো না। মৃত্যুর বছর দশেক আগে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে আর দেখা হয়নি! আমি ক্ষুদ্র মানুষ। কিন্তু নীতি-আদর্শ ও সততা রক্ষা করে চলার চেষ্টার করি। সে কারণেই আল মাহমুদ আমার কাছ থেকে দূরে চলে যান। তাঁর কবিতা আমি পড়ি কিন্তু তাঁর আদর্শকে আমি ঘৃণা করি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভঙ্গকারী আমার চেনা আল মাহমুদের মৃত্যু হয়েছে যেদিন তিনি জাসাস এবং পরে জামাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন! আমি হারিয়েছি আমার প্রিয় কবিকে এবং একজন প্রিয়তর মানুষকে, যাকে আমরা আমাদের নিজস্ব লোক হিশেবে পেতে চেয়েছিলাম! কিন্তু দুর্ভাগ্য, আদর্শহীনতার যখন কাউকে গ্রাস করে, তখন ভালোবাসার বন্ধনগুলোও ছিন্ন হতে বেশি দেরি লাগে না। আল মাহমুদ তার আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ! একজন কিংবদন্তি কবির ‘উল্কাপতনে’ আমরা মর্মাহত
লেখক : কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :