রুবাইদা আক্তার
‘রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক, সুনীল ভোরে’Ñ যুগে যুগে শিমুল ফুল নিয়ে এমনি গান কিংবা কবিতা রচনা করেছেন আমাদের দেশের সব সাহিত্যিকই। ফাল্গুনে শিমুলের বনে আগুন লাগে, সেই সময় রক্তরাঙা শিমুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন না এমন ব্যক্তি বোধহয় খুব কমই মেলে। একদিকে মেঘালয়ের কুয়াশা ঘেরা পাহাড় সারির অপার সৌন্দর্য অন্যদিকে যাদুকাটা নদীর তীরে শিমুল বাগানে হাজার হাজার গাছের ডালে ডালে রক্তরাঙা শিমুলের সমাহার। ঠিক যেন শিমুলের ডালে আগুন লেগেছে। এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য কল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে ধরা দেবে আপনারই কাছে যদি যান সুনামগঞ্জের শিমুল বাগানে। হ্যাঁ, সুনামগঞ্জে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল ফুলের বাগান যা চোখে না দেখলে বুঝতে পারবেন না আমাদের দেশেই রয়েছে এতো অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গ।
সুনামগঞ্জের জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়বদল ইউনিয়নের এই গ্রামটির নাম মানিগাঁও। গ্রামের পাশেই বহমান জাদুকাটা নদীর তীরেই এই শিমুল বাগানটির অবস্থান। বসন্তে রক্তরাঙা ফুলে ছেঁয়ে যায় পুরো বাগানটি। ডালে ডালে ঘুরে বেড়ায় পাখির দল। প্রকৃতি-প্রেমীদের চোখ জুড়িয়ে যায় এই দৃশ্য দেখে। আপনার চোখ বিশ্বাস করতে চাইবে না এই অসাধারণ রক্তিম সৌন্দর্যের ঝলকানি দেখে। বসন্ত এলে এখানে একসাথে দুহাজার গাছ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ১৫ বছর আগে বাদাঘাট (উত্তর) ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন নিজের প্রায় ২ হাজার ৪শ শতক জমি বেছে নিয়েছিলেন শিমুলগাছ লাগাবেন বলে। সে জমিতে তিনি প্রায় তিন হাজার শিমুলগাছ লাগিয়েছিলেন। দিনে দিনে বেড়ে ওঠা শিমুলগাছগুলো রূপ নিয়েছে পরিপূর্ণ শিমুল বাগানে।
শিমুল বাগান : পাহাড়-নদী বিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এমন একটি স্থানে সারি সারি শিমুল গাছ দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সারি সারি গোলাকার গাছ, চিকন ডাল, ন্যাড়া মাথায় ঝুলে থাকা ফুলগুলো এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে রেখেছে। মন কেমন করা আবেশে মাতিয়ে রেখেছে চারপাশ। যাদুকাটা নদীর তীরে ১শ বিঘারও বেশি জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই শিমুল বাগানটি। নদীর অপারে মেঘালয়ের পাহাড়, মাঝে মায়ার নদী যাদুকাটা আর এপারে রক্তিম ফুলের সমারোহ, অগনিত পাখির কলকাকলি। এই মোহনীয় সৌন্দর্য দেখে মনে হবে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে এক টুকরো স্বর্গ। গাছের নীচে ছেঁয়ে থাকা ঝরা ফুলের ওপর হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে স্বর্গীয় লাল গালিচায় বুঝি আপনি হেঁটে যাচ্ছেন।
এতো লাল ফুল হয়তো একসাথে কখনোই দেখেননি। জনমানবহীন চারদিকে শুধু পাখির কলকাকলি। বাসন্তী হাওয়ায় জুড়িয়ে যাবে প্রাণ। প্রতিটা গাছই ফুলে ফুলে ভরা। টকটকে লাল শিমুল ফুল যেমন আছে, তেমনি হালকা কমলা রঙের ফুলও দেখতে পাবেন এখানে। বিশাল এই শিমুলবাগানের এক প্রান্তে দাঁড়ালে অন্যপ্রান্তে দেখা যায় না। এখানে ডালে ডালে মধু খেতে আসে বুলবুলি, কাঠশালিক, হলদে পাখিরা। পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুখর থাকে গোটা বাগান। থেকে থেকে ফোটা ফুল মাটিতে পড়ে আর থপ করে শব্দ হয়। এ যেন সত্যিই রূপকথার এক রাজ্য। শিমুলবনের ভেতরেই লেবুর বাগান। লাল বনে এক টুকরো সবুজ পরিবেশটাকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। গড়িয়ে পড়া বিকেলে এই শিমুলবন তার সৌন্দর্যের ডালি মেলে ধরে দ্বিগুণ রূপে। সোনালি আলোতে লাল টকটকে ফুল এক মোহনীয় আবেশ তৈরি করে এখানে। দোয়েল, বুলবুলি, ফিঙে পাখিরা যেন নেচে ওঠে। এ ডাল থেকে ও ডাল মধু খুঁজে বেড়ায় ভ্রমরের দল।
উত্তরে ভারতের মেঘালয় এবং দক্ষিণে স্বচ্ছ জলের রূপবতী যাদুকাটা নদী। স্বচ্ছ পাথুরে এই নদীর একদিকে টলটলে পানি আর গভীর অংশে সবুজ পানি। এক নদীতে যেন দুই রঙের পানি। এই দুয়ের ঠিক মধ্যখানে এই শিমুল বাগান। ঠিক তার কাছেই আছে সুদৃশ্য বারেক টিলা। এই টিলায় বসেও এই ফাল্গুনে শিমুল বনের রক্তরাঙ্গা সৌন্দর্য ও যাদুকাটা নদীর রূপ উপভোগ করতে পারবেন। উঁচু এই টিলার ওপর থেকে দেখতে পাবেন ভারতের মেঘালয়ের বড় বড় পাথুরে পাহাড়। আবার টিলার ওপর আছে কুরচি ফুলের বন। একসঙ্গে এতো কুরচি গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। দল। বসন্তের যেকোনো সময় চলে যান এই অপরূপ শিমুল বাগানটিতে। আগুন রঙা এই শিমুলের রূপ রাঙিয়ে দেবে আপনার মনের প্রতিটি কোণ।
কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে শ্যামলী, মামুন, এনা ইত্যাদি পরিবহনের বাস যায় সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। ভাড়া পড়বে ৫০০-৫৫০ টাকা। অথবা ট্রেনে সিলেট হয়ে, সিলেট থেকে বাসে আসতে পারেন সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ শহর থেকে বারিক টিলার জন্য বাইক ভাড়া নেবেন। এক বাইকে ২ জন ওঠা যায়। বাইকের ভাড়া ১৫০-২০০ টাকা। বারিক টিলা থেকে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই শিমুল বাগান দেখিয়ে দেবে।
কোথায় থাকবেন : বড়ছড়া বাজারে রেস্ট হাউজ আছে ২০০-৪০০ টাকায় থাকা যায়। বারেক টিলা পাড় হয়েই বড়ছড়া বাজার। চাইলে টেকেরঘাট থেকে হেঁটেও আসতে পারবেন বড়ছড়া বাজারে। এছাড়াও লেকের পাশে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি চুনা পাথরের কারখানা আছে তার গেস্ট হাউজে থাকতে পারবেন যদি খালি থাকে। এ ছাড়া উপজেলা ডাকবাংলোতেও থাকতে পারেন।
এ ছাড়া সুনামগঞ্জে ২শ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকার মধ্যে থাকার জন্য হোটেল ভাড়া পাওয়া যায়। নিচে কিছু হোটেলের নাম ও ঠিকানা দেয়া হলো : ১। হোটেল নূর-পূর্ববাজার স্টেশন রোড সুনামগঞ্জ। ২। হোটেল সারপিনিয়া-জগন্নাথবাড়ী রোড, সুনামগঞ্জ। ৩। হোটেল নূরানী, পুরাতন বাস স্ট্যান্ড , সুনামগঞ্জ। ৪। হোটেল মিজান, পূর্ব বাজার-সুনামগঞ্জ। ৫। হোটেল প্যালেস, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন রোড। ৬। সুরমা ভ্যালী আবাসিক রিসোর্ট। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :