যুগান্তর : এই তো ফেব্রুয়ারি আবার। ফিরে এসেছে বাঙালির দৃপ্ত-সাহসী চেতনার এই মাস। উনিশ শ’ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির একটি দিনই বদলে দিয়েছে আমাদের দেশ সম্পর্কিত ভাবনাচেতনা। এই একটি দিনই আমাদের চেতনার গভীরে রোপণ করেছে বাঙালি জাতিসত্তার বীজ।
সেই প্রথম পুরো বাঙালি জনগোষ্ঠী গভীর বেদনার মধ্য দিয়ে অনুভব করেছে হাজার মাইল দূরবর্তী দুই ভিন্ন দেশের মানুষ কখনও একটি অভিন্ন দেশ গড়তে পারে না। জীবনসংস্কৃতিগত নানা ভিন্নতা দুই ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মনোচৈতন্যে ফেলে সুগভীর ভিন্ন প্রভাব।
শুধু ধর্মীয় সংস্কৃতি কখনও তাদের এক করতে পারবে না। উনিশ শ’ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি তাই আমাদের জাতিসত্তার বীজকে দ্রুত অঙ্কুরিত করে পরিণত করেছে মহীরুহে। আমাদের মনোভূমে জাগিয়ে তুলেছে সুগভীর স্বদেশপ্রেম আর মাতৃভাষাপ্রীতি।
বাঙালির সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল এই মাসে- বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাহান্নর এই মাসে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে আমাদের সোনার ছেলেরা বাঙালির চেতনায় দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়েছিল।
বাহান্নয় অর্জিত সেই চেতনাই আমাদের মনোভূমে বুনে দিয়েছে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। পুরো দেশের মানুষের হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন। আর তাই একাত্তরে যখন নিপীড়ন ও গণহত্যা শুরু হল, তখন দেশের যুবসমাজ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ- বাংলাদেশ।
সেই থেকে বাঙালি স্বপ্ন দেখেছে এক সমৃদ্ধ দেশের- স্বপ্ন দেখেছে মাতৃভাষায় আত্মপ্রকাশের অমল বাসনার। কিন্তু বেদনার মধ্য দিয়ে আজও অনুভব করি সেই স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। ভাষা আন্দোলনের পর কেটে গেছে সাতষট্টি বছর।
বাংলা ফিরে পেয়েছে তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। বাঙালিও তার মুখের ভাষা- মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। কিন্তু বেদনার বিষয় এই যে, বাঙালি তার প্রিয় মাতৃভাষাকে আজও সর্বস্তরে চালু করার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার দেখা পায়নি।
বেদনা আরও নানা ক্ষেত্রেই আছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার নেই। মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা বিজ্ঞানের পাঠ নিই না- আইনের ক্ষেত্রে আমাদের মাতৃভাষা আজও উপেক্ষিতই থেকে গেল। অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও বাঙালি যেন বাংলা ভাষার উপেক্ষিত।
ধনিক-বণিকদের মধ্যে যেমন দেশপ্রেমের অভাব, তেমনি তারা অবজ্ঞা করেন মাতৃভাষাকেও। নিজেদের সন্তান তারা পড়তে পাঠান বিদেশে। দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা রয়েছে আমাদের আজ সর্বত্রই।
আমি মনে করি, যে জাতি তার মাতৃভাষা ভালোভাবে শিখবে না- সেই জাতি কোনো ক্ষেত্রেই উন্নতির শিখরে উঠবে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে না শিখলে কোনো জ্ঞানই পূর্ণতা পাবে না কখনো। জ্ঞানচর্চার মাধ্যম না হলে ভাষার বিকাশও হবে বাধাগ্রস্ত। আমাদের সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ হবে না ।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে তার জন্য বিন্দুমাত্র দেরি করলে চলবে না এবং এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। কারও ওপর, কারও অপেক্ষায় ফেলে রাখলে চলবে না।