স্বপন দেব : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে প্রায় ৪ শতাধিক মধু চাষী মৌ চাষে অনেকটা নীরব বিপ্লব এনেছেন। তাদের মধু চাষে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ও সরকারি কোন সহযোগিতা ছাড়াই নিজেদের স্বল্প পুঁজি দিয়ে দরিদ্র চাষীরা মধু উৎপাদন শুরু করেছেন। তবে বর্তমানে বিসিক ও বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে অনেকটা সক্ষম হয়েছেন। মৌ চাষের মাধ্যমে পরির্বতন এসেছে তাদের পারিবারিক অবস্থায়। কিন্তু ৬-৭ বছর আগেও মধু চাষের বিষয়টি এ এলাকার চাষীরা কল্পনাও করতে পারেনি, সেই চাষীরা আজ তাদের উৎপাদিত মধু বাজারজাত করে বছরে প্রায় কোটি টাকা আয় করছেন। সরকারি থেকে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে এ উপজেলা হয়ে উঠতে পারে মধু চাষের অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্র।
১৯৯৮ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কাঁঠালকান্দি গ্রামের মধু শিকারি মো. আজাদ মিয়া। রানি মৌমাছি ধরার পর তাঁর খামারে মধু চাষে সাফল্য আসতে শুরু করে। তার হাত দিয়ে প্রথম মধুচাষের সূচনা হয়েছিল কমলগঞ্জে। মধু চাষের জন্য প্রয়োজন রানি মৌ মাছির, কিন্তু সেই রানির দেখা তো মেলে না। কিছুদিন পর আজাদ দেখেন পাহাড়ি এক জলার ধারে দল বেধে মৌমাছি এসে পানি পান করছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। সেখান থেকে মৌমাছিদের পিছু ধরেন মধু চাষী আজাদ। এক সময় বনের ভেতর দেখা পান বিশাল মৌচাকের। দেখাও পান রানি মৌমাছির। কৌশলে সেই রানিকে ধরে সুতা দিয়ে বেঁধে রাখেন এক স্থানে। পরে দেখা গেল মাত্র ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে অনেক মৌমাছি রানির কাছে ছুটে এসেছে। রানিকে ঘিরে গুন গুন করছে। এরপর রানিকে বাড়িতে এনে রানিকে রাখা হলো একটি কাঠের বাক্সে। কয়েক দিনেই সেই বাক্সের আশপাশ মৌমাছির গুঞ্জনে সরব হয়ে ওঠে। সেসময় চার মাসের মধ্যেই বাক্সে প্রায় আট কেজি মধু পাওয়া গেল।
এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মধু চাষীদের সংখ্যা। প্রথমে আদমপুর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের মধ্যভাগ কালারায়বিল, ছয়ঘরি, কাঁঠালকান্দি, কোনাগাঁও, কানাইদাশী, রাজকান্দি, আধকানি, পুরান-বাড়ি, নয়াপত্তনসহ প্রায় ২৫টি গ্রামে চাষ হলেও বর্তমানে পৌরসভা, শমসেরনগরসহ আরো ইউনিয়নের মানুষ আগ্রহী হয়ে মধু চাষে মনোযোগী হয়েছেন। বর্তমানে এ উপজেলায় প্রায় ৩৫টি গ্রামে বারো মাসই মধু সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এখন প্রায় ৪ শতাধিক চাষী মধুচাষে জড়িয়ে পড়েছেন। এই মধু চাষিদের অনেকেই এটাকে বাণিজ্যিকভাবে বাড়তি আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অনেকে একমাত্র জীবিকার উপায় হিসেবে নিয়েছেন। এই মধু চাষের জন্য বাড়তি জমির প্রয়োজন নেই। ঘরের এক পাশে, বারান্দায় বা বাড়ির ঝোপঝাড়ের পাশে বাক্স রাখলেই চলে। মৌচাক বানানো, মধু সংগ্রহের বাকি কাজটুকু করবে মৌমাছি। একটি বাক্স থেকে এক মৌসুমে ৫ থেকে ২৫ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। বছরে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়, শ্রাবণ ও পৌষ এই মাসগুলোতে মৌচাকে মধু ভালো জমে। এখানকার চাষীদের উৎপাদিত মধু মৌলভীবাজার, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে উন্নত প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকায় কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয় চাষীদের। তার পর কেজি প্রতি ১০০০/৮০০ টাকা দরে বিক্রয় করেন চাষীরা। শুধু এলাকায় নয় প্রবাসীরাও মধু কিনে বিদেশ নিয়ে যাচ্ছেন। আলাপকালে চাষী মোস্তাফিজুর রহমান, খালেদ আহমেদ বলেন, কোন ধরনের প্রশিক্ষন ছাড়াই নিজেদের চেষ্টায় তারা মধু চাষ করছেন। সরকারী উদ্যোগে চাষীদের প্রশিক্ষণ ও তাদের উৎপাদিত মধু বাজারজাত হলে যেমন আরও অধিক উৎপাদন সম্ভব হতো তেমনি বাজার মূল্য আরও বেশী পাওয়া যেতো।
আপনার মতামত লিখুন :