মহিব আল হাসান: বাংলাদেশের ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ চলচ্চিত্রে মেকাপম্যান আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এরপর ১৯৯৪ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ পাওয়া সিনেমায় মেকাপম্যান আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করে পেয়েছেন বাংাদেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়া বেশকিছু চলচ্চিত্রে মেকাপম্যানের কাজ করে চলচ্চিত্র পাড়ায় তার পরিচিতি ছিল প্রসারিত। কিন্তু তিনি তার পুরস্কারটি রাখতে পারেননি, জাতীয় পরুস্কারটি বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক আগেই। কিন্তু এখন এই মেকাপম্যান জীবন চালান অন্যের কাছে হাত পেতে অর্থ্যাৎ ভিক্ষাবৃত্তি করে চলতে হয় তাকে। ভিক্ষার টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা এবং সংসার চালান তিনি। বলছি জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত মেকাপম্যান কাজী হারুনের কথা।
একসময়ের পরিচিত এই মেকাপম্যান কাজী হারুন এখন থাকেন দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ফরিদাবাদ বস্তিতে। সঙ্গে থাকেন স্ত্রী মহুয়া আকতার। মুলত স্ত্রীর অন্যের বাড়িতে কাজের টাকা দিয়ে ঘড় ভাড়া দেন এবং স্বামীর ভিক্ষার টাকা দিয়ে চলে তাদের সংসার।
কাজী হারুনের স্ত্রী মহুয়া তার স্বামীকে নিয়ে অঝোর নয়নে আমাদের সময় ডট কমকে জানান, ‘চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন ১৯৬৫ সালে মিলন সিনেমার মাধ্যমে । এরপর ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিতে কাজ করে বেশ প্রশংসিত হন তিনি। এর পর একটি ছবির জন্য সরকারে কাছে পরস্কার পান (জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার)। হঠাৎ করে ২০০৯ সালে তিনি ব্রেইন স্ট্রোক করেন (মষিÍকে রক্ত ক্ষরণ) হয় তার। এতে শরীরের ডান পাম অকেজো হয়ে যায়। অসুস্থতার কারণে তিনি চলচ্চিত্রে কাজ করতে না পারায় এখন অনেক কষ্ট করে জীবন চালাতে হচ্ছে তাকে।
কীভাবে অসুস্থ হলো জানতে চাইলে মহুয়া বলেন, গাজীপুরে ২০০৯ সালে একটি সিনেমার শুটিং শেষ করে বাড়ি ফেরেন। বাড়িতে এসে বাথরুমে গেলে তিনি যখন ৩০মিনিটও বের হচ্ছেন না তখন উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলে দেখি উনি মেঝেতে পড়ে আছেন। এরকম দেখে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে ডাক্তার বলেন ব্রেইণ স্টোক করেছেন। প্রায় তিনমাস হাসপাতালে থাকার পর জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়। চিকিৎসার পর থেকে ঠিকমত কথা বলতে পারে না। তার শরীরের একপাশ অবোশ হয়ে গেছে।
ভিক্ষাবৃত্তিতে আসার বিষয়ে বলেন, কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী মহুয়া। তখন তাঁর পাশে নীরবে কাঁদছিলেন হারুনও। অনেকটা বাধ্য হয়ে ২০১১ সালে ভিক্ষা শুরু হয়েছে। অভাবে তাড়নায় এরই মধ্যে বিক্রি করেছেন সোনার মেডেল। ‘মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর আমাদের ঘরে আর কোনো টাকা অবশিষ্ট ছিল না। বাড়ি ভাড়া দিতে পারি না, ঘরে খাবার নাই। কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদলেন। তারপর বের হয়ে গেলেন বাসা থেকে। এক মাস আমরা অনেক খুঁজেছি। কিন্তু উনাকে কোথাও পাইনি। তারপর একদিন বাড়ি এলেন। বললেন কমলাপুর ছিলেন, দিন-রাত ভিক্ষা করেছেন, রাতে ইট মাথায় দিয়ে ঘুমিয়েছেন। আমি এরই মধ্যে পাশের এক বাড়িতে কাজ করে কিছু খাবার সংগ্রহ করি। বেঁচে থাকার জন্য এখন বাক শক্তি হারানো ভিক্ষায় একমাত্র অবলম্বন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে পাওয়া মেডেল সম্পর্কে মহুয়া বলেন, ‘আমার মেয়ের বিয়ে হয় ২০১০ সালের দিকে। তখন আমাদের হাতে কোনো টাকা ছিল না। বাড়িতে যে টাকা ছিল, তা চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয়েছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে আমরা মেডেলটি বিক্রি করেছি। মেডেলে এক ভরি স্বর্ণ ছিল। তখন স্বর্ণের দাম ছিল মাত্র আট হাজার টাকা। আর যে পুরস্কারটি ছিল, সেটি বিক্রি করতে পারিনি। কারণ পিতলের কোনো দাম নাই। সেটা আমরা ফেলে দিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহুয়া বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। তিনি তো কত শিল্পীকেই সহযোগিতা করেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনিই তো হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এখন আমরা চলতে পারছি না। আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করি আর আমার স্বামী ভিক্ষা করেন। যদি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাহায্য করতেন তাহলে হয়ত আমরা স্বাভাবিকভাবে জীবন চালাতে পারতাম। প্রধানমন্ত্রী তো আনেক অসুস্থ শিল্পীদের সাহায্য করেন সেদিক বিবেচনা করে যদি আমাদের সহযোগিতা করতেন তাহলে আমাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব হত।
‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছাড়াও তিনি ‘অন্য জীবন’, ‘শঙ্খমালা’, ‘গোলাপী এখন ঢাকা’, ‘জীবন সংসার’সহ শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :