নিউজ ডেস্ক: ডাটাভিত্তিক সেবা চালুর পর ভয়েস কলের মূল্য কমে যায়। টেলিযোগাযোগ সেবায় এটাই আন্তর্জাতিক চর্চা। বাংলাদেশেও থ্রিজি, ফোরজি সেবা চালুর পর ভয়েস কলের ট্যারিফ কমবে বলে ধারণা ছিল সবার। কিন্তু তা না কমে উল্টো বাড়ানো হয়েছে। ভয়েস কলে এতদিন সর্বনিম্ন ট্যারিফ ২৫ পয়সা থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে ৪৫ পয়সা পুনর্নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এতে ভয়েস কলে গ্রাহককে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, যাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতির পরিপন্থী হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেশী ভারতেও থ্রিজি, ফোরজি সেবা চালুর পর ভয়েস কলের মূল্য একেবারে কমে গেছে। কোনো কোনো অপারেটর বিনামূল্যে ভয়েস কলের সুবিধাও দিচ্ছে। এটা শুরু হয়েছে মূলত রিলায়েন্স জিওর হাত ধরে। ২০১৬ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই গ্রাহক টানতে বিনামূল্যের ভয়েস কল ও ডাটা সুবিধা দেয়া শুরু করে অপারেটরটি। জিওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্য অপারেটররা গ্রাহকদের বিনামূল্যের ভয়েস কলের সুযোগ দিচ্ছে। ভারতের টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও একে টেলিকম আইনবহির্ভূত ও পরিপন্থী নয় বলে মনে করছে। গত বছর সে দেশের কয়েকটি সেলফোন অপারেটর ভয়েস কল সেবায় সর্বনিম্ন কলরেট বেঁধে দেয়ার আবেদন করলেও তা নাকচ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ভয়েস থেকে ডাটায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে দেশে থ্রিজি আসার পর থেকেই। এটি আরো গতি পেতে শুরু করেছে চলতি বছর ফোরজি প্রযুক্তি চালু হওয়ায়। প্রচলিত ভয়েস কলের পরিবর্তে অ্যাপভিত্তিক বিভিন্ন সেবার মাধ্যমেই কথা বলার প্রয়োজন সারছে গ্রাহক। তার পরও ভয়েস কলের ওপর এখনো নির্ভরশীলতা রয়েছে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। সেলফোনের ট্যারিফ সার্কিট পুনর্নির্ধারণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মূলত এসব গ্রাহকই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ সিদ্ধান্তকে টেলিযোগাযোগ সেবার আন্তর্জাতিক চর্চার বিরুদ্ধ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাইদ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ভয়েস কলের সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দেয়ার এখতিয়ার নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার। প্রতিযোগিতা নিয়মের মধ্যে থেকে হচ্ছে কিনা, সেটা তদারকির জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে। কিন্তু বিটিআরসির এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের হাস্যাস্পদ অবস্থান তৈরি হয়েছে। সর্বোপরি দেশের বিপুলসংখ্যক গ্রাহককে এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।
সেলফোন অপারেটরদের অননেট (নিজস্ব নেটওয়ার্ক) ও অফনেট (অন্য অপারেটরের নেটওয়ার্ক) ভয়েস কলে এতদিন ভিন্ন হারে ট্যারিফ বিদ্যমান ছিল। আগের ট্যারিফসীমা অনুযায়ী অননেট কলে আয় বেশি ছিল গ্রাহক সংখ্যার ভিত্তিতে বড় অপারেটরের। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা হিসেবে ধরে অননেট কল থেকে মাসে গ্রামীণফোনের গড় আয় ২৮০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। একই কল রেট ধরে অননেট থেকে রবির ১১২ কোটি ৩৮ লাখ, বাংলালিংকের ৭১ কোটি ৩৬ লাখ ও টেলিটকের আয় ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অন্যদিকে সর্বনিম্ন ৬০ পয়সা ধরে অফনেট কল থেকে গ্রামীণফোনের মাসিক আয় ৭৫ কোটি ৩৫ লাখ, রবির ১০৩ কোটি ৯৯ লাখ, বাংলালিংকের ৭৮ কোটি ৪০ লাখ ও টেলিটকের আয় ২০ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেই কল ট্যারিফের সীমা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মূলত এক রেট হওয়ার ফলে গ্রাহকের ক্ষতি হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। কেবল একটি অপারেটর ব্যবহার করলে এফএনএফ বা অননেটের সুবিধা না থাকায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে পুরো খাতের চিত্র বিবেচনায় নিলে এতে সুবিধাই হবে। ভবিষ্যতে এমএনপি চালু হলে এ সুবিধা আরো বাড়বে।
বিশ্বের কোথাও অননেট-অফনেটে আলাদা কল রেট নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো একটি অপারেটর বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। অফনেট-অননেট রাখলে সুবিধা পাবে এ ধরনের বড় অপারেটর। এতে প্রতিযোগিতার অবস্থা কখনই তৈরি হবে না। আমরা এমন ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে পারি না, যেখানে প্রতিযোগিতা থাকবে না। ন্যূনতম কলরেট বেঁধে দেয়া না হলে সেটির অপব্যবহার হয়।
টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১ অনুযায়ী প্রদেয় সেবা প্রদানের আগেই সংশ্লিষ্ট অপারেটরকে সেবাটির সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ চার্জের হার কমিশনের অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে হবে। এটি অনুমোদনের আগে সেবা প্রদান বা তার জন্য কোনো চার্জ আদায় করতে পারবে না অপারেটর। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য আইনে ট্যারিফ সীমা নির্ধারণ করার বিষয়ে কোনো বিধান রাখা হয়নি। তবে জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিমালা, ১৯৯৮-এ সুলভে সর্বোচ্চ মানের সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে ট্যারিফের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করতে পারবে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ট্যারিফের সীমা বেঁধে দিতে পারে বিটিআরসি। আইন অনুযায়ী বিটিআরসি প্রস্তাব দিলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের ভিত্তিতে তা কার্যকর করা হয়। ট্যারিফ নির্ধারণে কমিটি করা হয়েছিল। তারা সব ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দিয়েছে। এর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কল ট্যারিফ সীমা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে বিটিআরসি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, নতুন ট্যারিফ সার্কিটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ হয়েছে। মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) সেবা চালুর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এর প্রয়োজন ছিল। এতে ছোট-বড় সব অপারেটর সমান সুবিধা পাবে। এখন সেবার মান দিয়ে বিদ্যমান গ্রাহক ধরে রাখা কিংবা নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করতে হবে তাদের। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানসম্পন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিতে ট্যারিফসীমা নির্দিষ্ট না করেও আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সেবা প্রদানের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সিং নীতিমালাতেই উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া তুলনামূলক দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) বিষয়ে বিধিমালা জারির সুযোগ রয়েছে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও বাজারে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য কমিয়ে আনতে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এসএমপিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ ট্যারিফ ও করহার আরোপ করা হয়। ২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) একজন বিশেষজ্ঞকে এসএমপি বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। এটিকে অন্তর্ভুক্ত করে ২০১১ সালে প্রতিযোগিতা প্রবিধানমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলেও তা চূড়ান্ত হয়নি। সম্প্রতি এসএমপি রেগুলেশন, ২০১৮ তৈরিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
রবি আজিয়াটার হেড অব করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স শাহেদ আলম বলেন, পরিবর্তিত সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মূল্যের ফলে সেবামূল্যের স্বচ্ছতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকরা আরো মানসম্মত, উদ্ভাবনী ও সাশ্রয়ী মূল্যের সেবা গ্রহণ করতে পারবে। আমাদের পর্যালোচনা অনুযায়ী, এটি বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করবে ও গ্রাহকের ব্যয় ৩-৫ শতাংশ কমে আসবে।
একক মূল্য ব্যবস্থা দেশের টেলিযোগাযোগ বাজারে ভারসাম্য নিয়ে আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন থেকে গ্রাহক কোন অপারেটরে কল করছে, এ নিয়ে আর ভাবতে হবে না, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো যেকোনো অপারেটরে একই মূল্যে কথা বলতে পারবে। এতে দেশের টেলিযোগাযোগ শিল্পে বহু প্যাকেজের যুগ শেষ হলো, যা নিয়ে গ্রাহকদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হতো। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে; প্রত্যেক অপারেটরই একক রেটের অফার চালু করছে। নতুন মূল্য কাঠামোর ফলে বাজারে সুষম প্রতিযোগিতাও নিশ্চিত হবে, যা আগের মূল্য কাঠামোয় সম্ভব ছিল না। সুষম প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হওয়ায় গ্রাহকদের সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদান করে গ্রাহকের আরো আস্থা অর্জন করতে পারব বলে আমাদের প্রত্যাশা।
গ্রাহক সংখ্যা ও আয়ের ভিত্তিতে সেলফোন সেবা খাতের নিয়ন্ত্রণ মূলত তিন অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবির নিয়ন্ত্রণে। কমিশনের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশে সেলফোনের গ্রাহক সংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়েছে। গ্রাহক সংখ্যার ভিত্তিতে গ্রামীণফোনের মার্কেট শেয়ার ৪৫ দশমিক ৮২ শতাংশ, রবির ২৯ দশমিক ৬৩, বাংলালিংকের ২২ দশমিক শূন্য ৫ ও টেলিটকের ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এয়ারটেলের সঙ্গে একীভূতকরণের পর গ্রাহক সংখ্যা ও মার্কেট শেয়ার বেড়েছে রবির। আয়ের ভিত্তিতে গ্রামীণফোনের মার্কেট শেয়ার ৫১ দশমিক ৩৩, রবির ২৫ দশমিক ৪৭, বাংলালিংকের ২০ দশমিক ২২ ও টেলিটকের ২ দশমিক ৯৮।
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, যেকোনো নেটওয়ার্কে অভিন্ন রেটে কলের সরকারি সিদ্ধান্ত সামগ্রিকভাবে টেলিকম ভয়েস কল সেবার মূল্য নির্ধারণের জটিলতাকে কমানোর পাশাপাশি গ্রাহকদের অধিক স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছে। এখন একজন গ্রাহক বাংলাদেশের ১৫ কোটিরও অধিক নম্বরে অভিন্ন রেটে কল করতে পারছে, যা আগে সম্ভব ছিল না। এ সিদ্ধান্তের সুবিধা এমএনপি সেবা চালু হওয়ার পর সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যাবে। একটি গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলালিংক সবসময়ই গ্রাহকদের বাড়তি সেবা দিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
অপারেটরদের কলপ্রতি ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫ সালে অফনেট কল রেট কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় বিটিআরসি। ওই সময় তাতে অনুমোদন দেয়নি মন্ত্রণালয়। গত বছরের আগস্টে আবারো সেলফোন অপারেটরদের কল ট্যারিফসীমা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করে বিটিআরসি। এটি সংশোধন করে বর্তমান হারে প্রস্তাব করলে মন্ত্রণালয় তাতে অনুমোদন দেয়।
এর আগে ২০১০ সালের মার্চে ‘কস্ট মডেলিং, ইন্টারকানেকশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যান্ড ট্যারিফ পলিসি’ শীর্ষক প্রকল্প চালু করে বিটিআরসি। এতে সহায়তা দিচ্ছে আইটিইউ। প্রকল্পটির আওতায়ই সেলফোন অপারেটরদের কল ট্যারিফসীমা ২৫ পয়সা থেকে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশন্স সৈয়দ তালাত কামাল বলেন, কল ট্রাফিক সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। আগামী কয়েক সপ্তাহের ডাটা বিশ্লেষণ করার পর এ সম্পর্কে মন্তব্য করা সম্ভব হতে পারে।সূত্র: বণিক বার্তা
আপনার মতামত লিখুন :