ডেস্ক রিপোর্ট : ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে দ্বিতীয় বারের মত সিরিজ জয় করলো বাংলাদেশ। ২-১ এ সিরিজ জয় করে টেস্টে লজ্জাজনক হারের একপ্রকার প্রতিশোধই নিলো টাইগার বাহিনী। নিজেদের চেনা ফরমেটে স্বরূপে ফিরে ক্যারিবিয়দের ৩য় ওয়ানডেতে ১৮ রানে হারিয়ে সিরিজটি জয় করে নেয় মাশরাফিরা।ম্যাচে উত্তেজনা ছড়ানোর কথা ছিল না। ব্যাটে বলে দুর্দান্তই ছিল বাংলাদেশ। তবে শেষদিকে ম্যাচটি ঠিকই উত্তেজনা ছড়িয়েছে। যে উত্তেজনাকে পাশ কাটিয়ে শেষ হাসি হেসেছে টাইগাররাই। ১৮ রানের জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-১'এ হারিয়ে সিরিজ জিতেছে মাশরাফির দল।
৩০২ রানের বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরু থেকে সেভাবে চড়াও হয়ে খেলতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে মারমুখী ছিলেন ক্রিস গেইল, করেন ৬৬ বলে ৬ বাউন্ডারি আর ৫ ছক্কায় ৭৩ রান। শাই হোপ ৬৪ করলেও খরচ করেন ৯৪টি বল। শেষদিকে রভম্যান পাওয়েলের ৪১ বলে ৭৩ রানেই জয়ের সম্ভাবনা জেগেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
বাংলাদেশের পক্ষে ২টি উইকেট পেয়েছেন মাশরাফি।
এর আগে সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচের শুরুর অর্ধেকটা মন মতোই করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। রান বন্যার সেন্ট কিটস মাঠে রানের খোঁজে ধুঁকতে হয়নি বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের। আগের দুই ম্যাচের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে আবারও রান করেছেন তামিম ইকবাল। শেষদিকে ঝড় তুলেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
এই দুইয়ের ব্যাটে ভর করেই মূলত বড় সংগ্রহ দাঁড় করাতে পেরেছে টাইগাররা। প্রায় বছর দুয়েক পর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জয়ের মিশনে আগে ব্যাট করে বাংলাদেশের ইনিংস থেমেছে ৩০১ রানে।
সিরিজে টানা তৃতীয়বারের মতো টসে জেতেন বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। প্রথম ম্যাচে করেন আগে ব্যাটিং, দ্বিতীয় ম্যাচে নেন আগে বোলিং। তৃতীয় ম্যাচে এসে আবারও আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন টাইগার অধিনায়ক। জানিয়ে দেন ব্যাট করার জন্য খুবই সুবিধাজনক হবে সেন্ট কিটসের এই উইকেট।
কিন্তু তামিম ইকবাল ও এনামুল হক বিজয়ের উদ্বোধনী জুটিতে মনেই হয়নি উইকেট ব্যাটিং বান্ধব। আগের দুই ম্যাচে বড় রান করতে ব্যর্থ হওয়া বিজয় এই ম্যাচেও আউট হয়েছেন অল্পতেই। ৩১ বলের ইনিংসে রান করতে পেরেছেন মাত্র ১০। উইকেটে একবারের জন্যও স্বচ্ছন্দ মনে হয়নি তাকে। দলীয় ৩৫ রানের মাথায় সিরিজে তৃতীয়বারের মতো তামিমকে একা করে দিয়ে সাজঘরে ফেরেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান।
jagonews24
আগের দুই ম্যাচের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতেও। বন্ধু তামিমের সঙ্গে সাকিব আল হাসান আবারও গড়েন ইনিংসের ভীত গড়ে দেয়া জুটি। তামিমের ধীরস্থির ব্যাটিংয়ের সাথে ছিল সাকিবের উইকেটের চারপাশে রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখা ব্যাটিং। চোখের পলকে মাত্র ১৬ ওভার ব্যাট করে এই জুটিতে যোগ হয় ৮১ রান।
টানা তৃতীয় অর্ধসেঞ্চুরির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সাকিব ফিরে যান টপ এজ হয়ে স্কয়ার লেগে ধরা পড়ে। আউট হওয়ার আগে সাবলীল ব্যাটিংয়ে ৩ চারের মারে করেন ৩৭ রানে। খেলেন মাত্র ৪৪টি বল। সাকিব ফিরে গেলেও ক্যারিয়ারের ৪৩তম অর্ধশত তুলে নিতে কোন ভুল করেননি তামিম।
অর্ধশত পেরিয়ে মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে নতুন করে ইনিংস গড়ার কাজে মন দেন তামিম। কিন্তু দারুণ শুরু করা মুশফিক অদ্ভুত এক শট খেলতে গিয়ে সাজঘরে ফিরে যান মাত্র ১২ রান করে। তার ব্যাট থেকেই আসে ইনিংসের প্রথম ছক্কাটি। দলীয় সংগ্রহ দেড়শ পার করিয়েই সাজঘরে ফিরে যান। অন্যপ্রান্তে অবিচল থেকে যান আস্থার আরেক নাম হয়ে ওঠা তামিম।
চতুর্থ উইকেট জুটি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে পেয়ে যেন খানিক নির্ভার হন তামিম। খেলতে শুরু করেন হাত খুলে। জোড়া বাউন্ডারিতে পৌঁছে যান ৮০’র ঘরে। জাগিয়ে তোলেন সিরিজে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির সম্ভাবনা। পরে নব্বইয়ের ঘরে ঢুকে ৯২ থেকে এক ছক্কায় চলে যান ৯৮ রানে।
বাকি দুই রান নেন সাবধানী ব্যাটিংয়ে এক-এক করে। তুলে নেন ক্যারিয়ারের একাদশ ও চলতি সিরিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। তবে সেঞ্চুরির পর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি বাঁহাতি এই ওপেনার। ব্যক্তিগত ১০৩ রানের মাথায় দেবেন্দ্র বিশুর ওভারে মিড উইকেটে ধরা পড়েন তামিম।
তিন ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি ও এক ফিফটিতে ২৮৭ রান করে তামিম গড়েন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তিন ম্যাচ সিরিজে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ভেঙে দেন ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষেই গড়া দীনেশ রামদিনের ২৭৭ রানের রেকর্ড।
তামিম ফিরে যাওয়ার পরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাব্বির-মোসাদ্দেকের আগেই ব্যাট হাতে নেমে যান অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। নিজের বলা ‘এই উইকেটে ব্যাটিং সহজ হবে’ কথাটার বাস্তব প্রমাণ দিতেই নেমে যান মাশরাফি। ব্যাটিংয়ে নেমে সময় নেননি খুব বেশি।
অপর প্রান্তে নির্ভরতার প্রতীক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ থাকায় নির্ভয়ে খেলতে পারছিলেন মাশরাফি। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক জেসন হোল্ডারের এক ওভারে হাঁকান পরপর তিন বাউন্ডারি। হোল্ডারের পরের ওভারেই লংঅনের উপর দিয়ে মারেন এক ছক্কা। রিয়াদ-মাশরাফির জুটিতে চোখের পলকে ২৫০ পেরিয়ে যায় বাংলাদেশের সংগ্রহ।
পঞ্চম উইকেটে মাত্র ৪২ বলে ৫৩ রান পায় বাংলাদেশ। ২৫ বলে ৪ চার ও ১ ছক্কার মারে ৩৬ রান করে ফেরেন মাশরাফি। অপর প্রান্তে বাংলাদেশ দলের ফিনিশিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে অবিচল ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। স্লগ ওভারে ব্যাটিংয়ে আসেন হার্ডহিটার হিসেবে পরিচিত সাব্বির রহমান।
কিন্তু সাব্বিরের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক খেলছিলেন মাহমুদউল্লাহই। এতোক্ষণ ধরে উইকেটে থেকে বিশাল এক ছক্কার মারে রিয়াদ তুলে নেন ক্যারিয়ারের ১৯তম অর্ধশতক। শুরুতে ব্যাটে-বলে এক করতে পারছিলেন না সাব্বির। ৪৯তম ওভারে পরপর দুই বলে দুটি ৪ মেরে পরের বলেই সাজঘরে ফিরে যান তিনি।
তবে অপরাজিতই থেকে যান মাহমুদউল্লাহ। শেষপর্যন্ত তার দুর্দান্ত ফিফটিতেই ৩০০ পেরিয়ে যায় বাংলাদেশ। শেষের দশ ওভারে আসে ৯৬ রান। মাত্র ৪৯ বলে ৫ চার ও ৩ ছক্কার মারে ৬৭ রান করেন রিয়াদ। ৫ বলে এক চারের মারে ১১ রানের ইনিংস খেলেন মোসাদ্দেক। বাংলাদেশের ইনিংস থামে ছয় উইকেটে ৩০১ রানে।
স্বাগতিকদের পক্ষে দুইটি করে উইকেট নেন অ্যাশলে নার্স ও জেসন হোল্ডার।
এর আগে নড়বড়ে এভিন লুইসকে ফেরানো গেছে, ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা গেইলকেও। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রত্যেক ব্যাটসম্যানই এদির যেন পণ করে নেমেছেন হারার আগে হারবেন না! একই মন্ত্র নিজেদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন বাংলাদেশের বোলাররাও। তাতে লড়াই উঠেছে জমে।
সেন্ট কিটসে ৩০২ রানের লক্ষ্যে দুই উইকেটে দেড়শ পেরিয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গেইল ৬৬ বলে ৭৩ করে ফিরেছেন রুবেলের বলে ক্যাচ দিয়ে। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান হেটমায়ার ও শাই হোপ লড়াই এগিয়ে নিচ্ছিলেন। তাদের ৬৭ রানের জুটি ভেঙে ৩০ করা হেটমায়ারকে বোল্ড করে মিরাজ বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরানোর চেষ্টা করেন।
আগের দুই ম্যাচের মতো এদিনও ব্রেক থ্রু এনে দেন মাশরাফী। প্রথম দুম্যাচে যেখানে তিরিশের কোটাই পেরোয়নি উইন্ডিজের উদ্বোধনী জুটি, সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে সেখানে পেরিয়ে গেল ফিফটি। সেখানেই ত্রাতা টাইগার অধিনায়ক। সিরিজে তৃতীয়বারের মতো আউট করেছেন লুইসকে।
তখন ক্রমেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার হুঙ্কার ছুড়ছিলেন ক্রিস গেইল, সঙ্গী লুইস থাকলেন মন্থর। তারপরও ১০.১ ওভারে ৫৩ রান তুলে ফেলে স্বাগতিকরা। এরপরই দৃশ্যপটে মাশরাফী। অফস্টাম্পের বাইরে করা তার অফ-কাটারটি লাফিয়ে ওঠে হঠাতই, লুইসের ব্যাট ছুঁয়ে জমা পড়ে মুশফিকের গ্লাভসে। ৫৩ রানের জুটি ভাঙে। বাঁহাতি ওপেনার ৩৩ বলে করে যান ১৩ রান।
গেইল পরেও চালিয়ে যান। ফিফটি তুলে নেয়ার পথে হোপকে নিয়ে ৫২ রানের আরেকটি জুটি গড়েছেন। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা এই বাঁহাতি লংঅন দিয়ে রুবেলকে উড়িয়ে মারতে যেয়ে মিরাজের হাতে ধরা পড়েছেন। থামে ছয় চার পাঁচ ছক্কায় ৬৬ বলে ৭৩ রানের ইনিংস। পঞ্চম ছক্কাটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গেইলের ৪৭৬তম। তাতে স্পর্শ করেছেন পাকিস্তানের শহিদ আফ্রিদির সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড।
সেন্ট কিটসে আগে ব্যাট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে নির্ধারিত ওভারে ৬ উইকেটে ৩০১ রান তুলেছে বাংলাদেশ। তামিমের শতক ও মাহমুদউল্লাহর অপরাজিত ফিফটিতে।
যাতে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে প্রথমবার তিনশ ছুঁয়েছে টাইগাররা। উইন্ডিজের বিপক্ষে আগের সর্বোচ্চটি ছিল ২৯২ রান, ২০১২ সালে খুলনায়। আর স্বাগতিকদের মাটিতে আগের সর্বোচ্চ ছিল এই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে করা ২৭৯ রান। জাগোনিউজ