রুহুল আমিন : সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষকদের এক গবেষনায় দেখা গেছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনের চারপাশের সব কারখানা পুরোদমে চালু হওয়ার আগেই ক্ষতি শুরু হয়েছে। সুন্দরবনের উপর অনাকাঙ্খিত অত্যাচারের শেষ নাই, এটি এখন সবচেয়ে বেশি খতির হুমকির সম্মুখীন।
শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরিইউ) গোলটেবিল মিলনায়তনে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে “সুন্দরবন ধ্বংস প্রক্রিয়ার সর্বশেষ অবস্থা ঃ সরকারি নির্লিপ্ততার প্রতিবাদ ও বন রক্ষার দাবিতে” এক সংবাদ সম্মেলন এতথ্য বলা হয় ।
গবেষণায় দেখা গেছে, বনের শুধু উদ্ভিদ ও প্রাণীই ধ্বংস হচ্ছে না, কারাখানার আশপাশের এলাকার খাদ্যচক্রও ভেঙ্গে পড়ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই শ্বাসমূলীয় বনের চারপাশে ২০০টির মতো কারখানা নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতির এই চিত্র পাওয়া গেছে। সব কারখানা নির্মাণ শেষে পুরোদমে চালু হলে ক্ষতির পরিমান আরও বাড়বে।
সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে মূল বক্তব্য রাখেন বাপার যুগ্মসম্পাদক ও ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশ এর সমন্বয়ক জনাব শরীফ জামিল। গবেষকদের নতুন গবেষণার চিত্র উল্লেখ করে তিনি জানান, পানিতে ভাসমান ক্ষুদ্র কণার সংখ্যা সুন্দরবনের পাশের শিল্পকারখানা এলাকায় অনেক বেশি, প্রতি লিটারে ৬৭৮ মাইক্রোগ্রাম। আর কারখানা নেই এমন এলাকায় তা প্রতি লিটারে ১৫.৮ মাইক্রোগ্রাম। ভাসমান ক্ষুদ্র কণা বেড়ে গেলে পানির নিচে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন পৌঁছায় না, এতে জলজ পরিবেশে পানির প্রথম স্তরের শক্তি উৎপাদক উদ্ভিদকণা ক্ষতি গ্রস্থ হয়। উদ্ভিদকণা হলো প্রাণীকণার প্রাথমিক খাদ্য। উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণা আবার মাছের খাদ্য। মাছ বড় প্রাণীর খাবার। এভাবে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণা থেকে শুরু করে বাঘ পর্যন্ত সুন্দরবনের খাদ্যচক্র গড়ে উঠেছে। উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণা কমে গেলে ধাপে ধাপে বাঘ পর্যন্ত ক্ষতি হবে।
তিনি আরো জানান, সমীক্ষায় সুন্দরবনের পাশে কারখানা আছে এমন এলাকার বনে উদ্ভিদ কণা পাওয়া গেছে ৩০ প্রজাতির। আর শিল্পকারখানা নেই এমন ্এলাকায় তা ৫১ প্রজাতির। এই দুই ধরনের এলাকায় যথাক্রমে ২০ ও ২৯ প্রজাতির প্রাণীকণা পাওয়া গেছে। জলজ পরিবেশের খাদ্যচক্র ভেঙে পড়ায় ব্যাঙের রেণুর ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। শিল্পকারখানার এলাকার মাটি দূষিত হয়ে পড়ছে। কারখানা রয়েছে এমন এলাকার প্রতি কেজি মাটিতে ১৫.৬ মাইক্রোগ্রাম তেল পাওয়া গেছে। আর শিল্প কারখানা নেই এমন এলাকায় এর পরিমান ৭.৬ মাইক্রোগ্রাম। শিল্প কারখানা এলাকায় বাতাসও দূষিত। সেখানে বাতাসে সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ক্ষুদ্র কনার পরিমান স্বাভাবিক এর চেয়ে কয়েকশগুন বেশী।
গবেষণায় কারখানার পাশ্ববর্তী নদীতে প্রতি ঘণ্টায় ৭-৮ ডলফিন দেখা গেছে, অথচ কারখানা নেই এমন ডলফিন দেখা গেছে ১৫-১৭টি। সমীক্ষায় কারখানার পাশে সুন্দরবন এলাকায় বাঘের বিচরণ কমেছে বলেও লক্ষ্য করেছেন গবেষকরা। গবেষণা এলাকার পশুর নদী ও খালসমূহে গবেষনাকালে বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেছে ৩-৪টি, অথচ ২০১০ সালের পূর্বে একই এলাকায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেছে ৯-১২টি ।
অন্যদিকে গবেষণায় লক্ষ্য করা গেছে সুন্দরীগাছের বীজ নষ্ট হচ্ছে ৭০%। সুন্দরবনের পশুপাখি, গাছ, বাঘ, বন্য শুকর, মাছসহ ২৫ প্রজাতির জলজ ও উদ্ভিদের সংখ্যা শিল্প-কারখানা এলাকায় কম বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এসব প্রজাতি মিলে বনের জীববৈচিত্র্য। এসব প্রজাতি হুমকীর মুখে পড়লে গোটা বনে এর প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, এর আগেও দেশীয় ও বিদেশী সঠিক, বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ, নিরপেক্ষ বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদগণ কর্তৃক রামপাল প্রকল্পের কারণে সংশ্লিষ্ট পানি, মাটি, ফসল, বন, মৎস, বনের গাছপালা, জন স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক প্রভাব ও মানবাধিকার ব্যতয় প্রভৃতি বিষয়ে মোট ১৪টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ২০ আগস্ট ২০১৭ তারিখে রামপাল বিষয়ক ১৩টি গবেষণাপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। পরিতাপের বিষয়, এসব সুলিখিত গবেষণা প্রতিবেদন বিষয়ে সরকার পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মতামত প্রদান করা হয়নি। সরকার এতদিন বলত, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং শিল্প কারখানার কারণে সুন্দরবনের ক্ষতির বিষয়ে আমাদের কাছে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য নেই। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নতুন গবেষণায়ও সুন্দরবনের ভয়াবহ ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে।
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, দেশবাসীর গভীর উদ্বেগ ও বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিপরীতে সুন্দরবন প্রশ্নে সরকারি নির্লিপ্ততা ও সুন্দরবন বিনাশী কার্যক্রমে সারাদেশবাসীই উদ্বিগ্ন। সুন্দরবন বিষয়ে ইউনেস্কোর শর্ত এবং রামসা, আইইউসিএন-সহ আন্তর্জাতিক সং¯’াগুলো অব্যাহতভাবে উদ্বেগ জানালেও সরকার কোন কিছুই কর্নপাত করছেন না, যা খুবই দুঃখজনক।
সুলতানা কামাল বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে প্রকল্পগুলো পুরোদমে শুরু হওয়ার আগেই, এর প্রভাব সুন্দরবন ঘিরে শুরু হয়েছে। তাই আমরা সরকারের কাছে আবারও আহবান জানাচ্ছি, বিজ্ঞানীদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে দেশ ও তার জনগণ, প্রকৃতি, সম্পদ, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের স্বার্থে সুন্দরবন বিনাশী কার্যক্রম বন্ধে পদক্ষেপ নেবেন।
বিশিষ্ট লেখক-বুদ্ধিজীবি ও বাপা’র সহসভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, দেশে সুন্দরবন প্রশ্নে আজ দুটি পক্ষ তৈরী হয়েছে এক পক্ষ সরকারি কিছু কর্মকর্তা, আর অন্য পক্ষ পরিবেশবিদ, গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ দেশ প্রেমিক সকলস্তরের জনগণ। সরকারি কিছু স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তার কারণেই আজ সুন্দরবন বিনাশী একের পর এক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাই সরকারকেও স্বার্থান্বেষী এই মহলের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। আমরা আশা করবো বিশেষ মহলের স্বার্থ রক্ষা না করে, দেশের সম্পদ-পরিবেশ ও জনস্বার্থে সুন্দরবন বিনাশী কার্যক্রম বন্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেবেন এবং সুন্দরবনকে রক্ষা করবেন।
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও বাপা’র সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রতিঘাত মোকাবিলায় অক্ষত-সতেজ সুন্দরবন একটি বিশাল প্রয়োজনীয় বিষয়। এই প্রতিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর কাছে যে ন্যায়সিদ্ধ আকাক্সক্ষা বা প্রাপ্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে, তার সাথে কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এবং কিছু মুনাফালোভী ব্যক্তির স্বার্থে সুন্দরবনের প্রতি সরকারের অবহেলামূলক মনোভাব ও নির্লিপ্ততা প্রবলভাবে বেমানান।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমাদের আশংকাই গবেষণার তথ্যে আবারও প্রমাণিত হলো। আমরা বারবার বলে আসলেও সুন্দরবন বিনাশী কার্যক্রম চলছেই। আর এসকল কার্যক্রম এখনই বন্ধ না হলে দিনে দিনে সুন্দরবন আরো ধ্বংসের দিকে যাবে। তিনি সুন্দরবন রক্ষায় সকলকে সোচ্ছার হওয়ার জন্য আবারও আহবান জানান।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক জনাব শামসুল হুদা বলেন, সুন্দরবন ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্প ও প্লট বরাদ্দের কারণে শুধু সুন্দরবনই নয়, পাশ্ববর্তী কৃষিজমিও বিনষ্ট হচ্ছে। যার প্রভার পড়ছে স্থানীয় জনগনের জীবন-জীবিকা, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর।
সংবাদ সম্মেলন থেকে নিন্মোক্ত দাবীসমূহ উত্থাপন করা হয়, সুন্দরবন বিষয়ে ইউনেস্কো বিশ^ ঐতিহ্য কমিটির প্রস্তাব সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে; নির্মানের সকল কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী বা অভ্যন্তরের নির্মাণাধীন ও পরিকল্পিত ৩২০টি ও সকল সরকারি-বেসরকারী প্রকল্প ও স্থাপনা অপসারণ, নির্মাণাধীন প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ বরাদ্দকৃত সকল প্লট অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি কর্তৃক সরকারের নিকট জমাকৃত ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিবেদন, সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন ও ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্য কমিটির জুলাই ১৭ সভার সুপারিশের ভিত্তিতে বন রক্ষায় সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সুন্দরবনের উপর আরোপিত অন্যান্য সকল অনিয়ম অত্যাচার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। বন বিভাগের জনবল বৃদ্ধি ও তাদের কাজের পরিধি, একাগ্রতা, সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :