মমিনুল হক: মুদ্রা খুঁজতে গিয়ে রাজশাহী নগরীর সপুরা এলাকার মঠপুকুরে একটি নন্দী মূর্তি পেয়েছে ১২ বছর বয়সী কিশোর লাম মোহাম্মদ ও ইমন বাদশা । ষাঁড়ের মতো দেখতে এই মূর্তিটি শিবের বাহন হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়দের সহযোগিতায় পরে সেটি সপুরা শিল্পনগরী পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, গত বৃহস্পতিবার মঠপুকুরে পাওয়া নন্দী মূর্তিটি কালো পাথরের তৈরি এবং যদি তা-ই হয়, তাহলে এটি অন্তত বারো শতকের আগে তৈরি হওয়া একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। গবেষক ও পণ্ডিতদের মতে, বাংলায় তুর্কি অভিযানের পর আর কালো পাথরের মূর্তি তৈরি হয়নি। ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে বাংলায় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির অভিযানের পর হিন্দুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মূর্তি পুকুরের পানিতে অথবা মাটির নিচে লুকিয়ে ফেলেছিল।|
রাজশাহীর সপুরা এলাকার মঠপুকুরে প্রচুর প্রাচীন মুদ্রা, চাঁদির মোহর, আংটি ও মালা পাওয়া গেছে। এসব প্রাচীন নিদর্শন খুঁজে পাওয়ার লোভে শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ পুকুরটিতে অনেক দিন ধরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। তারা খুঁজে পাওয়া ওই সব নিদর্শন মুদ্রা সামান্য মূল্যে বিক্রিও করে দিচ্ছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, 'প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে নন্দী মূর্তির গুরুত্ব অপরিসীম। নন্দী শিবের বাহন হলেও নন্দীকে আলাদা করেও নির্মাণ করা হতো। এটি পাওয়া গেলে অবশ্যই আমাদের গবেষণার প্রয়োজন হবে।' বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের উপ-প্রধান সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস প্রাপ্ত মূর্তিটির ছবি দেখে নিশ্চিত করেন, 'এটি একটি নন্দী মূর্তি। দেখেই মনে হচ্ছে, এটি একটি অমূল্য সম্পদ। মূর্তিটি যদি কালো পাথরের হয় তাহলে এটি বারো শতকের দিককার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর শিল্প ও প্রত্নমূল্য অনেক।'
হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, তার ধারণা, সপুরার মঠপুকুরটি ১৭৫০ সালের পর খনন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, 'মারাঠা বর্গি হামলার পর ১৭৪২ সালের দিকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এসে মুর্শিদাবাদে আশ্রয় নেয়। তাদেরই কেউ কেউ রাজশাহীতে এসে রেশম ব্যবসা করত এবং সপুরা অঞ্চলে যারা বাস করতে শুরু করে, তারা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারাই এই মঠটি তৈরি করে এবং দেবতাদের সম্মান জানাতে তারা মঠ ও পুকুরে পয়সা ছিটাত।' তাহলে এই পুকুরে বারো শতকের কালো পাথরের মূর্তি কীভাবে আসবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'এমন হতে পারে, এখানকার বাসিন্দারা অন্য কোথাও থেকে মূর্তিটি নিয়ে এসেছিল
লাম জানায়, বৃহস্পতিবার মুদ্রা খুঁজতে গিয়ে সে প্রথমে মাটির নিচে পাথরের মাথা দেখতে পায়। এর পর কিছুক্ষণ সেটি তোলার চেষ্টা করে না পেরে বন্ধু ইমনকে জানায়। তারা দু'জন চেষ্টারত থাকতেই পাশে থাকা চান মিয়া ও অমর দাস এসে হাত লাগান। এক পর্যায়ে অমর দাস মূর্তিটি একটি রিকশায় তুলতেই পুলিশ এসে তা বিসিক ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। তাদের অনুমান, মূর্তিটির ওজন ১০০ কেজির বেশি হবে
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, 'এই পুকুরটি অনেক প্রাচীন। ঘাটটি ভাঙা; কিছুতেই ঠিক হয়নি। ঘাট না ভাঙলে বুঝতে পারতাম, এটা কত প্রাচীন।' মুদ্রা বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা শুনে তিনি বলেন, 'সর্বনাশ! এগুলো প্রাচীন সম্পদ; বিক্রি করা ঠিক হচ্ছে না। আমি পুকুরটিতে লোক না নামার জন্য এখনই প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব
নগরীর বিসিক শিল্পনগরীর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মাসুদ রানা জানান, পুকুরটি ভারতীয় হাইকমিশনের টাকায় সংস্কার করছে সিটি করপোরেশন। মাটি-পানি, কাদায় ডুবে থাকা মূর্তিটি দুই শিশু এবং দু'জন লোক উদ্ধার করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরে তা পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে রাখা হয় এবং সেখান থেকে বোয়ালিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়। বোয়ালিয়া থানার ওসি আমান উল্লাহ বলেন, 'আদালতের নির্দেশে মূর্তিটি কোথায় রাখা হবে তা নির্ধারণ করা হবে। আপাতত থানাতেই রাখা হয়েছে। সূত্র-সমকাল