ইমরান রহমান : প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে ঘটছে একাধিক হত্যাকাণ্ড। যার বেশিরভাগই বীভৎস ও রোমহর্ষক। সর্বশেষ গত বুধবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে এক তরুণীর কোমর থেকে নিচের অংশ পাওয়া যায় একটি ট্রলি ব্যাগে। কোমর থেকে উপরের অংশ না পাওয়ায় তার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এরআগে, গত রবিবার গভীর রাতে পূর্ব মাদারটেকে দক্ষিণ বনশ্রী প্রজেক্টে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মধ্যে একটি লাগেজ থেকে শাহ আলম ভুঁইয়া (৬৫) নামে এক আদম ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তার গলায় রশি পেচানো ছিল।
শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র আপন স্বজনরাই বেছে নিচ্ছেন খুনের মতো নিকৃষ্ট পথ। স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, মা খুন করছে সন্তানকে, সন্তান খুন করছে বাবাকে, স্বামী পুড়িয়ে মারছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। খুনের পরে বীভৎস লাশগুলো নাড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের বিবেক। একটা মানুষ কিভাবে এতটা নৃশংস হতে পারে? সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুসারে, গত ৩ মাসে রাজধানীতে ৫২টি ও সারাদেশে ৮৭৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে অধিকাংশই বীভৎস ও রোমহর্ষক। সর্বশেষ গত ৭ দিনে রাজধানীতে ৫টি বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বুধবার যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী টোল প্লাজার সামনে ফেলে যাওয়া এক ট্রলি থেকে অজ্ঞাত এক তরুণীর লাশের শুধু কোমরের অংশ পাওয়া যায়। ডিএমপির ডেমরা জোনের সিনিয়র এসি ইফতেখাইরুল ইসলাম জানান, যেখান থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়েছে সেই স্থানটি যাত্রাবাড়ী থানা থেকে ৪-৫ মিনিটের দূরত্ব। ব্যাগটি মূল সড়কের পাশেই ছিল। একজন খারাপ মনে (হয়ত চুরি করার উদ্দেশ্যে) ব্যাগটি একটু দূরে সরিয়ে নেয়। পরে ব্যাগটি খুললে ভেতরে লাশ দেখতে পায়। ওই ব্যক্তি বিষয়টি পাশের একজন দোকানিকে জানায়। দোকানি থানায় খবর দিলে পুলিশ গিয়ে ব্যাগসহ মরদেহটি উদ্ধার করে। এসি বলেন, যেহেতু তরুণীর মুখমণ্ডলের অংশটুকু পাওয়া যায়নি। তাই তার পরিচয় শনাক্ত করাও সম্ভব হয়নি। আমরা মরদেহের বাকি অংশ খুঁজছি এবং নিহতের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।
এর আগে গত সোমবার রাতে মিরপুরে শাহআলীতে তাসলিমা বেগম (৪০) নামে এক গৃহবধূকে পাটা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে পাষণ্ড স্বামী। গত ২০ মার্চ কালাচাঁদপুরে গারো সম্প্রদায়ের বেসেত চিরান (৬৫) ও তার মেয়ে সুজাতা চিরানকে (৪২) নৃশংসভাবে খুন করা হয়। একই দিনে ভিক্ষা না দেয়ার কারণেই ইন্দিরা রোডে দোকান ম্যানেজার জুলহাস মিয়াকে (৫০) হত্যা করে এক ভিক্ষুক। গত ১২ মার্চ ভাটারার কুড়িলে নেশার টাকা না দেয়ায় ছেলের হাতুড়ির আঘাতে মা সালমা আক্তার (৬৫) নিহত হন। গত ৮ মার্চ ভরদুপুরে পশ্চিম নাখালপাড়ার ২৮৮ নম্বর রসুল ভিলা নামের বাড়িটির একটি ফ্লাট ভাড়া নিতে এসে বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে (আমেনা বেগম-৬৫) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে এক কিশোরীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনাগুলো ছাড়াও গত ৪ মাসে রাজধানীতে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাসহ বেশ কয়েকটি মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, বীভৎস হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে বীভৎসতা বাড়ছে। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে অনেকেই।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আইন থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগ না থাকায় এমন খুনের ঘটনা বেড়ে গেছে। অতীতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে ক্ষুব্ধ হয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে মানুষ। মূলত যেকোনো সামাজিক অপরাধের ৬ মাস পর বিচার হলে সেটি আর কেউ মনে রাখে না। ফলে সেও ওই একই ধরনের অপরাধ করতে দ্বিধা করে না। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনি কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন্স) সহেলী ফেরদৌস ভোরের কাগজকে বলেন, সব ধরনের খুন আগ থেকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। যেসব ঘটনায় খুনাখুনি কিংবা সহিংসতায় রূপ নিতে পারে সেসব বিষয়ে পুলিশ আগ থেকে সতর্ক অবস্থানে থাকে, খোঁজখবর নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তারপরও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটে। এসব কমিয়ে আনতে পুলিশ সর্বাত্মক সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :